শিল্পপতি রাহুল বজাজ
এক রাহুলে রক্ষা নেই, আরও এক রাহুল দোসর!
এ দিনই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণে মাত্রা ছাড়িয়েছেন রাহুল গাঁধী। আবার আজই সরকারের সমালোচনায় বেনজির ভাবে সবর হলেন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি রাহুল বজাজ।
বছর ঘোরার আগেই মোদী সরকারের ‘অচ্ছে দিন’-এর আশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অধৈর্য হয়ে উঠছিল শিল্প মহল। সেই ক্ষোভেরই প্রতিফলন এ বার শোনা গেল রাহুল বজাজের মুখে। বজাজ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান রাহুল আজ মন্তব্য করেছেন, ‘‘মোদী সরকার ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। সত্যি বলতে, এই সরকারকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বলেই মনে হচ্ছে না!’’ বজাজের দাবি— যে ঐতিহাসিক নির্বাচনী জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল মোদী সরকার, সেখান থেকে অধোগতি শুরু হয়েছে। দিল্লির নির্বাচন, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচন তার প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘‘২০১৪-র ২৭ মে আমরা এক সম্রাটকে পেয়েছিলাম। ২০-৩০ বছরে বিশ্বের খুব কম জায়গায় এমন সাফল্য দেখা দিয়েছিল। আমি এই সরকারের বিরোধী নই। কিন্তু বাস্তব হল, সেই ঔজ্জ্বল্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে।’’
রাহুল বজাজ শিল্প মহলে বরাবরই স্পষ্ট বক্তা বলে পরিচিত। এমন নয় যে তিনি বরাবরই মোদীর সমালোচক। উল্টে একটা সময় নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসাই করতেন। তাই তিনি যে কথা বলছেন, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছে না শিল্প মহল। বরং বণিক সভাগুলিতে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, শিল্প মহলের ক্ষোভই ফুটে উঠেছে বজাজের কথায়। বাকিরা যে কথা এখনই মুখ ফুটে বলতে চাইছেন না, সেটাই বলে দিয়েছেন রাহুল।
রাহুল বজাজ আজ মূলত মোদী সরকারের কালো টাকা আইনের সমালোচনা করেছেন। নির্বাচনী প্রচারে বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদী। কিন্তু তার জন্য অর্থ মন্ত্রক যে আইন তৈরি করেছে, তাকে শিল্প মহলের অনেকেই ‘দানবীয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আজ বজাজ যুক্তি দিয়েছেন, অর্থ মন্ত্রক জরিমানা দিয়ে কালো টাকা ঘোষণা করার জন্য তিন মাসের সময় দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও সে টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা হবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। বজাজের যুক্তি, ‘‘আমি কালো টাকা জানিয়ে দেবার পরে তুমি বলবে এটা বেআইনি, তা হলে আমি কিছুই জানাবো না। তার বদলে কী হয় দেখব আমি। দরকারে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করব। জীবদ্দশায় আমার কিচ্ছু হবে না!’’
বজাজের যুক্তি— ‘‘যারা কর ফাঁকি দিয়ে কালো টাকার মালিক হয়েছে, তাদের জন্য কোনও সহানুভূতি নেই। কিন্তু আইনের খসড়া দেখে মনে হচ্ছে, সকলকেই দোষী বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের থেকে এমনটা আশা করা যায় না।’’ এই ক্ষোভ যে আসলে সরকারের নীতির প্রতি অনাস্থা, তাতে শিল্প মহলের কোনও সন্দেহ নেই। বরং সামগ্রিক ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ বলেও মনে করা হচ্ছে।
কেন এই ক্ষোভ? শিল্প মহলের অনেকেরই বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদী যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বা যে লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছেন, তা বাস্তবে রূপায়ণ করার মতো প্রত্যয় তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। যার সব থেকে বড় উদাহরণ জমি অধিগ্রহণ বিলে সংশোধন। ইউপিএ-সরকারের জমি বিলে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ সম্ভব নয় বলেই তাতে সংশোধনের কথা বলেছিলেন। মোদী সরকার এখন সেখান থেকে পিছিয়ে এসে রাজ্যের ভরসায় বসে থাকছে। রাজ্যগুলিকেই প্রয়োজন মতো জমি আইন তৈরি করে নিতে বলা হচ্ছে। পণ্য-পরিষেবা কর বা জিএসটি-র ক্ষেত্রেও অনেকেই আগামী ১ এপ্রিল থেকে নতুন কর ব্যবস্থা চালু হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তার বদলে সরকার যে ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা খর্ব করতে এক কদম এগিয়ে দু’কদম পিছিয়ে আসছে, তা দেখেও হতাশ শিল্প মহল। আয়কর রিটার্ন ফর্ম, ম্যাট নিয়েও সরকারের এক এক বার এক এক রকম নীতি শিল্প মহলে বিরক্তি বাড়িয়েছে।
এক শিল্পপতির মতে, ‘‘রাজনীতির প্রয়োজনে অর্থনীতির সঙ্গে আপস শুরু হয়েছে। গত রেল বাজেটে মুম্বইয়ের শহরতলির ট্রেনে ভাড়া বাড়িয়েও পিছু হঠেছিল সরকার। অর্থনীতির প্রয়োজন ভুলে মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের কথাই সরকারের মাথায় ছিল। এখন মনে হচ্ছে, বিহার ভোটের কথা মাথায় রেখে সরকার জমি বিল নিয়ে এগোতে চাইছে না। তার বদলে ১০০ দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়াচ্ছে।’’
যার অর্থ স্পষ্ট। শিল্প বা ব্যবসার পরিবেশ মোদী জমানায় পাল্টাচ্ছে না। ফেব্রুয়ারি মাসে এই কথাটাই বলেছিলেন এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান দীপক পারখ। তাঁর মন্তব্য ছিল— ‘‘প্রথম নয় মাসে অর্থনীতির ছবিটা যে আরও খারাপ হয়নি, তা নেহাৎই মোদীর ভাগ্য। তার কারণ, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে মোদীর কোনও অবদান ছিল না। কিন্তু বাস্তবে শিল্প বা ব্যবসার পরিবেশ পাল্টায়নি। শিল্প সংস্থাগুলি লাভের মুখ দেখতে পারছে না। কারণ বাজারে চাহিদা নেই।’’ শিল্পের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে এত সময় কেন লাগছে, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন পারখ। মোদী জমানায় সরকারি সংস্থাগুলির কাজকর্মে বদল হয়নি বলে আজ বজাজও অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সকলেই বলছে, আয়কর দফতর, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের লোকেরা সব একই রকম রয়েছে। কালো টাকা ঘোষণা করলেই আপনাকে হেনস্থা করা হবে।’’ বজাজের মতে, বিহারে সরকার গঠন করতে পারলে এই অধোগতি কিছুটা রোখা যাবে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অসম ও পুদুচেরির বিধানসভা ভোটেও বিজেপির ভাল ফলের আশা রয়েছে। তার পরে যদি সরকারের কাজে
গতি আসে!