সতর্কতা ছিলই, বোঝা যায়নি লক্ষ্য পঞ্জাব

ঠিক তিন দিন আগের কথা। জম্মু-কাশ্মীর সরকারের কাছে পৌঁছেছিল দিল্লির সতর্কবার্তা। যাতে বলা হয়েছিল, সাম্বা সেক্টর দিয়ে জনা দশেক পাকিস্তানি জঙ্গি ভারতে ঢোকার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। দলটির নেতৃত্বে আছে ইকবাল নামে এক জঙ্গি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৫ ০২:৫৮
Share:

ঠিক তিন দিন আগের কথা। জম্মু-কাশ্মীর সরকারের কাছে পৌঁছেছিল দিল্লির সতর্কবার্তা। যাতে বলা হয়েছিল, সাম্বা সেক্টর দিয়ে জনা দশেক পাকিস্তানি জঙ্গি ভারতে ঢোকার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। দলটির নেতৃত্বে আছে ইকবাল নামে এক জঙ্গি। পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওই দলটির সদস্যদের কাছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ রয়েছে বলেও সতর্ক করে দেওয়া হয় মুফতি মহম্মদ সইদের সরকারকে।

Advertisement

ঠিক ৭২ ঘণ্টার ব্যবধান। সোমবার ভোরবেলা গুলির শব্দে ঘুম ভেঙেছে পঞ্জাবের গুরুদাসপুরের দীনানগরের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রাথমিক অনুমান, তিন দিন আগে যে দলটি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল, আজকের হামলার পিছনে তাদেরই ভূমিকা রয়েছে। প্রায় বারো ঘণ্টার লড়াই শেষে সন্ধ্যায় সরকারি ভাবে জানানো হয়, সংঘর্ষে তিন জঙ্গি মারা গিয়েছে। তাদের থেকে তিনটি এ কে ৪৭, প্রচুর গুলি, চিনা গ্রেনেড, জিপিএস ও মোবাইল উদ্ধার হয়েছে। জল্পনা থাকলেও কোনও জঙ্গির গ্রেফতারের সত্যতা রাত পর্যন্ত স্বীকার করতে চায়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।


কলকাতায় গোয়েন্দা বৈঠকের সেই সতর্কবার্তা।

Advertisement

গত মাসেই কলকাতায় রাজ্যস্তরের মাল্টি এজেন্সি সেন্টার বা ‘ম্যাক’-এর বৈঠকে উপকূলরক্ষী বাহিনীর কর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, পুজোর মরসুমে গুজরাত কিংবা মুম্বইয়ে ফের হানা চালাতে পারে পাক জঙ্গিরা। পাকিস্তানের কিছু রেডিও বার্তা বিশ্লেষণ করে উপকূলরক্ষী বাহিনী এ সম্পর্কে জানতে পারলেও কী ভাবে এবং ঠিক কোন জায়গায় হামলা হতে পারে, সে সম্পর্কে অন্ধকারেই ছিল তারা। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে ঢুকে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গিরা এ দেশে বড় হামলার ছক কষছে বলেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু গুরুদাসপুরে হামলার ঘটনা রীতিমতো চমকে দিয়েছে গোয়েন্দাদের। তাঁরা অন্য একাধিক রাজ্য নিয়ে সতর্ক হলেও তুলনায় দীর্ঘদিন ধরে শান্ত পঞ্জাব নিয়ে বেশ নিশ্চিন্তই ছিলেন। এখন নিরাপত্তা সংস্থাগুলির আশঙ্কা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর উৎসবের মরসুমে পশ্চিম উপকূলে তো বটেই, অন্য বহু রাজ্যেই ফের সংগঠিত ভাবে হানা দিতে পারে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা।

কেন পঞ্জাবকে বেছে নিল জঙ্গিরা?

এক সময় খলিস্তানি সন্ত্রাসে প্রায় প্রতিদিন রক্তাক্ত হতো পঞ্জাব। কিন্তু পুলিশ-গোয়েন্দাদের সক্রিয়তায় ও সরকারের তৎপরতায় ধীরে ধীরে দাপট কমে খলিস্তানিদের। তার মধ্যেও কখনও কখনও মাথা তোলার চেষ্টা করেছে জঙ্গিরা। কিন্তু সে ভাবে সফল হয়নি। পঞ্জাবে শেষ জঙ্গি হামলার ঘটনা ২০০৭ সালে। লুধিয়ানার একটি সিনেমা হলে বিস্ফোরণ। তার পর গত সাত বছরে খলিস্তানি জঙ্গিরা পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদতে আগের চেয়ে সক্রিয় হলেও বড় কোনও নাশকতার পথে হাঁটেনি তারা। আজ হামলার খবর আসতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসারেরা প্রাথমিক ভাবে মনে করেছিলেন, আইএসআইয়ের মদতে খলিস্তানি জঙ্গিরা ওই হামলা চালিয়েছে। কিন্তু দুপুরের দিকে কেন্দ্র জানিয়ে দেয়, পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার কয়েক জন সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢুকেছে। পাক সেনা ও পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদতেই এই জঙ্গিরা এ দেশে ঢুকেছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘গুরুদাসপুর ও মুম্বই হামলার মধ্যে একটা মিল আছে। উভয় ক্ষেত্রেই একাধিক জায়গায় হামলা চালিয়ে যত বেশি সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করাই লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের। কিন্তু গুরুদাসপুরে একেবারে ভোর বেলায় হামলা হয়েছে। ফলে সেই অনুপাতে প্রাণহানি এড়ানো গিয়েছে।’’

গোয়েন্দাদের ধারণা, এই জঙ্গিরা সাম্বা সেক্টর দিয়ে ভারতে ঢুকলেও জম্মু-কাশ্মীরের কড়া নিরাপত্তার জন্য পরিকল্পনা বদল করে অপেক্ষাকৃত ‘সফ্ট’ নিশানা গুরুদাসপুরকে বেছে নেয়। তা ছাড়া গুরুদাসপুর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরেই ভারতের অন্যতম বড় সেনা ছাউনি পাঠানকোট। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, গুরুদাসপুরে হামলা চালালে পরোক্ষে নয়াদিল্লিকেও বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে বলেই জঙ্গিরা এ পথ নিয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গ স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, ৩ জুন কলকাতায় ম্যাকের যে বৈঠক বসেছিল, সেখানেই উপকূলরক্ষী বাহিনী পাক জঙ্গিদের সক্রিয়তা নিয়ে সতর্ক করেছিল। এ দিন গুরুদাসপুরের ঘটনার পর ওই সতর্কবার্তা বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান এক গোয়েন্দা কর্তা। ম্যাকের বৈঠকে বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়। ওই গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ‘‘ভুলে গেলে চলবে না কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাদ দিলে ২০১৪ সালে দেশে মূলত তিনটি জঙ্গি হামলা হয়েছে। সেগুলি ১ মে চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে, ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ে এবং ২৭ ডিসেম্বর বেঙ্গালুরুতে। ফলে আমাদের চিন্তা পুরোপুরি যায়নি।’’

কলকাতায় ম্যাকের ওই বৈঠকে গোয়েন্দারা জেএমবি-র কাজকর্ম নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এক গোয়েন্দা-কর্তার বক্তব্য, বর্ধমান বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত জেএমবি-র পলাতক জঙ্গিরা এখনও রাজ্যে থাকা তাদের আত্মীয়-পরিজন এবং পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। কিন্তু তারা অধরাই! গোয়েন্দা কর্তাদের আশঙ্কা, বর্ধমান বিস্ফোরণের জেরে জেএমবি-র বেশ কয়েকটি মডিউলের লোকজন ধরা পড়ে যাওয়ায় ওই জঙ্গি সংগঠন প্রত্যাঘাত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গই যে তাদের মূল টার্গেট হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না বলে জানিয়েছে ম্যাকের সদস্য এক গোয়েন্দা-কর্তা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement