ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ছবি: সংগৃহীত
বর্তমানে দেশে সরকারের থেকে ভিন্নমত পোষণ করলেই ‘দেশদ্রোহী’ কিংবা ‘শহুরে নকশাল’ তকমা প্রয়োগ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু ভিন্নমত পোষণ দেশের চিরায়ত সংস্কৃতির অঙ্গ বলেই শনিবার একটি বক্তৃতায় তুলে ধরলেন ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। আমেরিকাবাসী ভারতীয়দের একটি সংগঠন আয়োজিত বক্তৃতায় রোমিলা জানান, ভারতীয় ইতিহাসে রাষ্ট্র যেমন ছিল, তেমনই রাষ্ট্রবিরোধী স্বরও ছিল। শাসকেরা বিরুদ্ধ স্বরের প্রতি কর্ণপাত করতেও বহু সময়ে বাধ্য হতেন।
‘ভয়েস অব ডিসেন্ট’ শীর্ষক বক্তৃতায় প্রাচীন এবং মধ্য ভারত থেকে রোমিলা সরাসরি চলে এসেছেন সমসাময়িক সময়ে। সাম্প্রতিক কালে ভারতে শাহিন বাগ এবং কৃষক প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নজর কেড়েছে। রোমিলার মতে, ভারতের চিরায়ত যে অহিংস বিরোধিতার সংস্কৃতি, এই দুই প্রতিবাদ তারই উত্তরাধিকার বহন করেছে। এই ধরনের আন্দোলন ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরতে পারে। এই দুই প্রতিবাদের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপেরও সমালোচনা কার্যত শোনা গিয়েছে প্রবীণ ইতিহাসবিদের গলায়। তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্র রক্ষার্থেই ভিন্ন স্বর আরও জোরালো হওয়া উচিত।”
বর্তমান বিজেপি শাসনকালে বারবার হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির কথা ফুটে উঠেছে। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, বিজেপির হিন্দুত্ববাদ আদতে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি। রোমিলাও এ দিন তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, আব্রাহামীয় ধর্ম (মূলত ইসলাম) বাদ দিয়ে কী ভাবে বাকি সব ধরনের ভারতীয় ধর্মকে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনা হয়েছে। কিন্তু রবিদাসের মতো বহু সাধুসন্ত মূলত ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতির বিরুদ্ধেই ভিন্ন স্বর পোষণ করতেন।
বর্তমান শাসন কালে দেশের বিশিষ্টজনদের বার বার সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে। রোমিলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই বিশিষ্টজনদের সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকা শ্রেয়, ইঙ্গিত দেন রোমিলা। এই প্রসঙ্গে তিনি জানান, প্রাচীন ভারতে আলেখ্য রচয়িতা বা চারণ কবিরাই শাসকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতার সামনের সারিতে থাকতেন এবং প্রয়োজনে অনশন করতেন। তাঁরা রাজবংশের বংশতালিকা ও গৌরবগাথা রচনা করলেও শাসকের অধীন হতেন না। বরং তাঁরা স্বাধীন সত্ত্বা বজায় রাখতেন। এঁরা অনশন করলে বা মারা গেলে শাসকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হত। তাই এদের ভিন্ন স্বরকে শাসকেরাও গুরুত্ব দিতেন। বস্তুত, ভিন্ন স্বরের স্বরূপকেই এ দিন তুলে ধরতে চেয়েছেন রোমিলা। ইতিহাসবিদ জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে যাকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “ভিন্ন স্বর মানে অন্ধ বিরোধিতা নয়, তা এক ধরনের বিকল্প মতও বটে।”
প্রশ্ন উঠছে, দেশের বর্তমান সরকার কি সেই বিকল্প মতকে আদৌ সম্মান করতে প্রস্তুত?