রঞ্জন সাহা
হাটে গিয়েছিলেন পাকা কলা কিনতে। তার পরে ১৬ বছর আর খোঁজ মেলেনি তাঁর। ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-এর খোঁজে আদালতে হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন বাড়ির লোকেরা। তখনই বাড়ি ফিরে এলেন আগরতলার বাসিন্দা রঞ্জন সাহা। জানালেন, বাংলাদেশে এনএলএফটি জঙ্গি শিবিরে কেটে গিয়েছে ১৬টা বছর। জঙ্গিদের ফাইফরমাশ খেটে, অত্যাচার সহ্য করে শেষে ফিরতে পেরেছেন বাড়িতে।
২০০০ সালের ১৮ এপ্রিল। ভরদুপুরে আগরতলার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন রঞ্জনবাবু। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জম্পুইজলা থেকে কলা কিনে এনে আগরতলায় বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু সে দিন আর বাড়ি ফেরেননি রঞ্জনবাবু।
দিনের পর দিন তাঁর কোনও খোঁজ না পেয়ে নানা জায়গায় দৌড়োদৌড়ি শুরু করেন রঞ্জনবাবুর পরিবারের সদস্যেরা। স্ত্রী সুমিত্রা ও বড় ছেলে অভিজিৎ জানিয়েছেন, জঙ্গিরা রঞ্জনবাবুকে অপহরণ করে থাকতে পারে বলে স্থানীয় সূত্রে জানতে পেরেছিলেন তাঁরা। তাই আগরতলা পূর্ব আর জিরানিয়া থানায় অভিযোগ করতে যান। কিন্তু লাভ হয়নি। অভিজিৎবাবু জানান, ‘‘সব থানাই বলে, জঙ্গিরা যে অপহরণ করেছে তার প্রমাণ কী? এ অভিযোগ আমরা নিতে পারব না।’’ তার পরে অনেক পুলিশ অফিসার, প্রশাসনিক কর্তা, মন্ত্রীর কাছে দরবার করেছেন তাঁরা। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।
অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘হতাশ হয়ে শেষে ডেথ সার্টিফিকেট চেয়ে মামলা করি। তাও সেই ২০০৭ সালে।’’ কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন রঞ্জনবাবু।
কী হয়েছিল তাঁর?
রঞ্জনবাবু জানাচ্ছেন, জম্পুইজলার হাট থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় কয়েক জন মুখঢাকা লোক। চোখ বেঁধে হাঁটিয়ে হাজির করে অজানা এক জঙ্গলঘেরা জায়গায়। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন এটা বাংলাদেশে এনএলএফটি জঙ্গিদের ঘাঁটি।
রঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘প্রচণ্ড খাটাত ওরা। ইনস্যাস, এসএলআর সাফ করতে হতো। ভাত-রুটির সঙ্গে দেওয়া হতো আদিবাসী খাবার, ঠান্ডা পানীয়।’’ জঙ্গিদের হাত-পা ম্যাসাজও করতে হয়েছে। কথা না শুনলে অকথ্য অত্যাচার করত জঙ্গিরা। এক দিন বন্দুকের নল গরম করে চেপে ধরেছিল মাথায়। রঞ্জনবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘অনেককে আমার চোখের সামনে মেরেও ফেলেছে। এখনও চট্টগ্রাম, রাঙামাটির জঙ্গি শিবিরে অনেকে আটকে আছেন।’’
বছরের পর বছর এ ভাবে কাটাতে কাটাতে এক সময়ে রঞ্জনবাবু জঙ্গিদের বলেন, ‘‘হয় মেরে ফেলো নয় ছেড়ে দাও। আর সহ্য করতে পারছি না।’’ কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ তাঁকে মুক্তি দেয় জঙ্গিরা। কিছু দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে সেখান থেকেই নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে দালালদের সাহায্যে সীমান্ত পেরিয়ে আসেন আগরতলায়।
বাড়িতে বসে বললেন, ‘‘১৬ বছর পরে এসেছি তো। প্রথমে স্ত্রী ছাড়া কাউকে তেমন ঠাহর করতে পারিনি।’’