উত্তরকাশীতে এই সুড়ঙ্গের একাংশ ভেঙেই বিপর্যয় ঘটেছে। ছবি: পিটিআই।
৬০ মিটার। ‘মাত্র’ ৬০ মিটার। ওই ৬০ মিটারেরই দূরত্ব যে কত দুস্তর হতে পারে, আজ ন’দিন ধরে তা টের পাচ্ছে উত্তরকাশী! গোটা দেশও!
সুড়ঙ্গে ধস নামার পরে পার হয়ে গিয়েছে ন’দিন। কিন্তু ধসে পড়া পাথর এখনও আটকে রেখেছে সুড়ঙ্গের ওই ৬০ মিটার। যার এক দিকে উদ্ধারকারীরা। অন্য দিকে, মুক্তির অপেক্ষায় উদ্গ্রীব, আটক ৪১ জন নির্মাণশ্রমিক। আজ রাতেই তাঁরা প্রথম রান্না করা গরম খাবার পেয়েছেন— বোতলে ভরা খিচুড়ি। লক্ষ্য, সুড়ঙ্গ-বন্দি শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ রাখা।
বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এসেছেন। পরিস্থিতির খোঁজ নিতে ফোন করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু ‘বাইরের দুনিয়ায়’ তাঁদের বাঁচাতে কী হচ্ছে, আটক নির্মাণশ্রমিকেরা এখনও তার কিচ্ছুটি জানেন না। গত দু’দিন ধরে তাঁরা পাথরের দেওয়ালে কান পাতলে, শুনতে পাচ্ছিলেন শুধু একটিই শব্দ। তা হল, পাথর কেটে পাইপ এগিয়ে আসার। যার মারফত এসে পৌঁছবে ভাত-রুটি-তরকারির মতো খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধ, এমনকি ইন্টারনেটের তারও! যাতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। জানানো যায়, বাইরে কী ঘটছে। কথা বলে জুগিয়ে রাখা যায় মনোবল। সেই পাইপ-সংযোগ হয়েছে সদ্য। বিশ্বের প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ এসেও বলছেন, কত দিনে উদ্ধার করা সম্ভব হবে, তার দিনক্ষণ বলা শক্ত, কার্যত অসম্ভব। তবে হ্যাঁ, লক্ষ্য একটিই— ৪১ জনকেই জীবন্ত উদ্ধার।
রবিবার রাতে দুর্ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছেন আর্নল্ড ডিক্স। সুড়ঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়ে যাঁকে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য করে তাবৎ দুনিয়া। দ্রুত উদ্ধারের থেকে বরং অক্ষত অবস্থায় ওই শ্রমিকদের বার করে আনার উপরে জোর দিয়েছেন তিনি। আর সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুষম খাবার। আর জরুরি দুর্গতদের মনোবল অটুট রাখা। পরিস্থিতির খোঁজ নিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ তাঁকে ফোন করেছিলেন বলে জানান উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী। শ্রমিকদের মনোবল যাতে কোনও ভাবে না ভেঙে পড়ে, তাতে মোদীও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ছ’ইঞ্চি ব্যাসের একটি পাইপ আজই ধসে পড়া পাথরের ভিতর দিয়ে শ্রমিকদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছয়। ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ডিরেক্টর অংশু মণীশ খালখো এটি উদ্ধার অভিযানের প্রথম সাফল্য বলে দাবি করেছেন। ওই পাইপ দিয়ে রাতে দুর্গত শ্রমিকদের খিচুড়ি, ডাল আর কিছু ফল পাঠানো হয় প্লাস্টিকের লম্বা বোতলে ভরে। ইতিমধ্যে তিন জন শ্রমিকের পেট খারাপের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ফলে কোন খাবার পাঠানো হবে, ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়েই তা ঠিক করা হচ্ছে। সদ্য পৌঁছনো ওই পাইপের ভিতর দিয়ে এ বার তার টেনে ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগও দেওয়া হবে। সেই যোগসূত্র শ্রমিকদের মনের জোর অনেকটা বাড়াতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুড়ঙ্গের ছাদ ফুঁড়ে আরও রসদ পাঠানোর জন্য পাহাড়ের উপরে একটি জায়গা থেকে সরু গর্ত খুঁড়তে শুরু করেছে রেলও।
উদ্ধারের জন্য এ পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে, তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন আর্নল্ড। তিনি বলেন, ‘‘অত্যন্ত কম সময়ে প্রচুর কাজ করা হয়েছে। আমরা আরও উপায়ের কথাও ভেবে রাখছি। দুর্গতদের যাতে নিরাপদে এবং সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা যায়, সেটাই মূল লক্ষ্য।’’ তিনিও বিলক্ষণ জানেন, হাতে সময় অফুরান নয়। কিন্তু তাড়াহুড়োয় বাড়তে পারে বিপদ।
উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলায় সিল্কিয়ারা থেকে বারকোটের মধ্যে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গপথে ধস নামে ১২ নভেম্বর, কালীপুজোর দিন সকালে। সেই থেকে ২০০ ঘণ্টারও বেশি বন্দি রয়েছেন ওই শ্রমিকেরা। ধসের ভিতর দিয়ে বড় পাইপ নিয়ে গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে আনার যে চেষ্টা হচ্ছিল, তা চার দিন ধরে বন্ধ। কারণ, শক্তিশালী যন্ত্র দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির সময়ে আরও ধস নামছিল। তা ঠেকাতে দরকার সুড়ঙ্গের চারপাশের দেওয়ালে কম্পনের ধাক্কা কমানো। সে জন্য কংক্রিটের দু’মুখ-খোলা ফাঁকা বাক্স তৈরি করেছে সেনা। যেখানে দিয়ে খনন-যন্ত্র প্রবেশ করছে, তার চার পাশের আলগা পাথর শক্ত করে ধরে রাখতে সেগুলি ব্যবহার করা হবে। যন্ত্র যাঁরা চালাবেন, তাঁদের সুরক্ষার জন্য চালা তৈরি হচ্ছে। আজ রাতের মধ্যে সেখানে ফের কাজ শুরু হতে পারে বলে আশা।
বারকোটের দিক থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ কাটা বাকি। তার মধ্যে দিয়েও একই ভাবে বড় পাইপ দিয়ে বেরোনোর পথ তৈরির কাজ ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা তেহরি হাইড্রো ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (টিএইচডিসি)।
শতদ্রু জলবিদ্যুৎ নিগমের (এসজেভিএন) দল পাহাড়ের কিছুটা উপরে পৌঁছে গিয়েছে। সুড়ঙ্গের ছাদ ফুঁড়ে উদ্ধারের পথ তৈরি করবে তারা। তাদের খননের একটি যন্ত্র এসেছে। গুজরাত ও ওড়িশা থেকে প্রায় ৭৫ টন ওজনের আরও যন্ত্র সড়কপথে রওনা হয়েছে। রেলের খনন-কাজের জন্য যন্ত্র আসছে দিল্লি আর নাসিক থেকে। ওই দুই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জন্য দ্রুত পথ তৈরি করে দিয়েছে বর্ডার রোডস অর্গানাইজ়েশন। আরও একটি পথ তৈরি চলছে। উপর থেকে উদ্ধারের পথ খননের জন্য সেটি দিয়ে যাবে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওএনজিসি। তাদের জন্য যন্ত্র আনা হচ্ছে মুম্বই, গাজ়িয়াবাদ আর আমেরিকা থেকে। বায়ু সেনাও আরও ৩৬ টন ওজনের যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার খবর দিয়েছে।
‘দক্ষ’ নামে একটি রোবট নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে এসেছে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন। সেটি মূলত বিস্ফোরক উদ্ধারে ব্যবহার হয়। দুর্গম পথ বা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে। ৯ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের কোনও জিনিস সরাতে পারে বেশ কিছুটা দূর থেকে।
উত্তরকাশীর ওই দুর্ঘটনায় উত্তরাখণ্ড হাই কোর্টে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জনস্বার্থ মামলা রুজু করেছে। আজ তার শুনানিতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্য সরকারকে রিপোর্ট দিতে বলেছে আদালত। ওই সংস্থা ঘটনায় ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের দাবিও জানিয়েছে আদালতে। সুড়ঙ্গ থেকে বেরোনোর আপৎকালীন পথ নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল আগেই। আজ সিল্কিয়ারায় গিয়ে উত্তরাখণ্ড বিধানসভার বিরোধী দলনেতা যশপাল আর্যও সে কথা বলেন। তাঁর দাবি, ওই পথ তৈরি করা হলে এত ক্ষণে ওই শ্রমিকদের উদ্ধার করে আনা যেত। দুর্ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবি করেছেন তিনি। আজ সিপিএম একটি বিবৃতিতে ন’দিন ধরে ওই শ্রমিকদের আটকে থাকা নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। বঙ্গ সিপিএমের এক্স হ্যান্ডলে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘‘মোদীর আধ্যাত্মিক পর্যটন সার্কিটের গিমিকের জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা বানাতে গিয়েই কি এই বিপর্যয়?’’
পাইপ বেয়ে খাবার পাঠানোর চেষ্টা থেকে রাজনীতির তরজা— ‘বাইরের দুনিয়ায়’ সুড়ঙ্গ-দুর্ঘটনাকে ঘিরে ঘটে চলেছে সবই। কিন্তু সুড়ঙ্গে আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিকের ভবিষ্যৎ এখনও অন্ধকারেই।