পাকিস্তানের মাটিতে মুম্বইয়ের তাজ হোটেল! তবে আসল নয়, তাজ হোটেলের একটা প্রতিরূপ মাত্র! আর তার মধ্যেই আজমল কসাব ও তার সঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল লস্করের শীর্ষ নেতারা। আমেরিকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে মুম্বইয়ের আদালতে সাক্ষ্যদানের দ্বিতীয় দিনে এমন চমকে দেওয়ার মতো তথ্যই জানাল পাক বংশোদ্ভূত মার্কিন লস্কর জঙ্গি ডেভিড কোলম্যান হেডলি।
আজ আদালতে এই জঙ্গির দাবি, ২০০৭-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে বৈঠক করে লস্করের শীর্ষ নেতারা। সেখানে হাজির ছিল লস্করের দুই নেতা সাজিদ মির ও আবু কাফা। তখনই টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় তাজ হোটেলকে। কিন্তু কেন তাজ হোটেল? হেডলির দাবি, ওই হোটেলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সেখানেই হামলা চালানোর প্রস্তাব দেয় সাজিদ মির।
হেডলির দাবি, জঙ্গিদের তরফে তাকে তাজ হোটেলের ভিডিও তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিজ্ঞানীদের সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল তাজের দোতলায়। তাই সেখানেই একটি ঘর ‘বুক’ করে হেডলি। সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী-ও। মধুচন্দ্রিমায় আসা দম্পতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ঘর নিয়েছিল তারা। তখনই সে পুরো হোটেলের ভিডিও তুলেছিল বলে দাবি হেডলির।
আদালতে হেডলির দাবি, তার তোলা ভিডিওর ভিত্তিতেই পাকিস্তানে তাজ হোটেলের একটি আস্ত সেট তৈরি করে ফেলে লস্কর! আর সেখানেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কসাব ও তার সঙ্গীদের। তারা কোন দরজা দিয়ে ঢুকে আক্রমণ চালাবে, কোন দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবে— সমস্ত খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের।
এক ভারতীয় গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ‘‘এ বার বোঝা যাচ্ছে, কেন জঙ্গিরা তাজে প্রায় সাত দিন ধরে লড়াই চালাতে পেরেছিল! আমরা ভেবেছিলাম, ওদের কাছে হোটেলের ম্যাপ ছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে নকল তাজে প্রশিক্ষণের ফলে আসল তাজের গলিঘুঁজি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল কসাবদের কাছে!’’ গোয়েন্দাদের মতে, লক্ষ্যবস্তুর মডেল বানিয়ে হামলার প্রশিক্ষণ সাধারণত কম্যান্ডোদের দেওয়া হয়। উগান্ডার এনটেবে বিমানবন্দর থেকে পণবন্দিদের উদ্ধারের আগে ইজরায়েলি কম্যান্ডোরা বিমানবন্দরের মডেলে মহড়া চালিয়েছিলেন। জঙ্গিদের এমন প্রশিক্ষণ পাক সেনাই দিতে পারে বলে ধারণা তাঁদের।
তবে ওই বিজ্ঞানী সম্মেলনে হামলাটা শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি লস্কর। হেডলি জানিয়েছে, ঠিক সময়ে কসাবদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া যায়নি। তবে তার পরেও তাজ হোটেলকে মূল লক্ষ্যবস্তুর তালিকা থেকে সরায়নি জঙ্গিরা। মুম্বইয়ের সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরে হামলার একটি ছকও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। হেডলির দাবি, মুম্বইয়ের নৌবাহিনীর দফতর, দক্ষিণ মুম্বইয়ে মহারাষ্ট্র পুলিশের সদর দফতরেরও ভিডিও তুলেছিল সে। পরে সেই ভিডিও এবং ওই দফতরগুলির জিপিএস অবস্থান লস্কর নেতা সাজিদ মিরের হাতে তুলে দেয়।
পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর সঙ্গে জঙ্গিদের যোগ নিয়ে আজ আরও তথ্য দিয়েছে হেডলি। গত কাল দু’জন আইএসআই অফিসারের কথা বলেছিল সে। আজ জানিয়েছে আরও চার জনের কথা। হেডলির দাবি, লস্করের হয়ে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি তাকে নিজেদের কাজেও লাগাতে চেয়েছিল আইএসআই। তাই কর্নেল শাহ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হামজা এবং মেজর সামির আলি নামে তিন অফিসার তাকে গোয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহ করতে বলেন। ভারতীয় সেনায় চর নিয়োগের চেষ্টা করতেও নির্দেশ দেয় আইএসআই। হেডলির দাবি, লস্কর নেতা ও মুম্বই কাণ্ডে অভিযুক্ত জাকিউর রহমান লকভিকে পরিচালনা করেন আইএসআই কর্তা ব্রিগেডিয়ার রিয়াজ। আজ লকভির ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করেছে হেডলি।
হেডলির সাক্ষ্য নিয়ে সন্ত্রাস-প্রশ্নে পাকিস্তানকে প্যাঁচে ফেলতে সক্রিয় হয়েছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে খবর, হেডলির থেকে পাওয়া তথ্য পাকিস্তানকে জানানো হলেও তারা স্বাভাবিক ভাবেই তা মানেনি। পাকিস্তানের বক্তব্য, ‘পুলিশের কাছে দেওয়া’ হেডলির জবানবন্দি সত্য নয়। তবে বিদেশ মন্ত্রকের মতে, হেডলি মার্কিন হেফাজতে থেকে ভারতের আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে। তাই তা এত সহজে ইসলামাবাদ উড়িয়ে দিতে পারবে না। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের উপরে চাপ বাড়ানোর জন্য ওয়াশিংটনেও দরবার শুরু করেছে ভারত। আজ মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র জন কার্বি বলেন, ‘‘মুম্বই হামলার দোষীরা যাতে শাস্তি পায়, সে জন্য ভারতকে সব ধরনের সাহায্য করতে দায়বদ্ধ আমেরিকা।’’