সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
নিয়োগ দুর্নীতিতে সব বড় মাথাকে এখনও সিবিআই গ্রেফতার করেনি কেন, সেই প্রশ্ন তুলল এ বার সুপ্রিম কোর্টও। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্তে সিবিআইয়ের দায়ের করা মামলা তুলে ধরে আজ সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে প্রশ্ন ছুড়েছে, তাদের নথিতে ১৭ জন অভিযুক্তের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৯ জনকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে? বাকিরা কেন মুক্ত? কেন প্রভাবশালীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না?
আজ নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ এবং ‘মিডলম্যান’ হিসেবে পরিচিত প্রসন্নকুমার রায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে গিয়েছেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় এই প্রথম এত বড় মাপের কোনও অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেলেন। সিবিআইয়ের অভিযোগ ছিল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগে দুর্নীতিতে ‘মিডলম্যান’ হিসেবে কাজ করতেন প্রসন্ন। তাঁর মাধ্যমেই চাকরি বিক্রির টাকা স্কুল সার্ভিস কমিশনের উচ্চপদস্থ কর্তা থেকে প্রভাবশালীদের কাছে পৌঁছত। প্রসন্ন জেলে বন্দি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আত্মীয়ও।
সুপ্রিম কোর্ট তাদের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সিবিআই সূত্রের অভিযোগ, রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তার ফলেই প্রসন্ন জামিন পেয়ে গেলেন। কারণ নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় সিবিআই এক বছর আগে চার্জশিট দায়ের করে ফেললেও আদালত তা এখনও গ্রহণ করেনি। কারণ ওই মামলায় রাজ্য সরকারের যে সব আধিকারিক অভিযুক্ত, তাঁদের কাঠগড়ায় তোলার জন্য রাজ্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন। এখনও রাজ্য সরকারের সম্মতি মেলেনি। আজ সেই ফাঁক দিয়েই প্রসন্ন জামিন পেয়ে গিয়েছেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ ও গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগ, এই দু’টি মামলায় সিবিআই প্রসন্নকে গ্রেফতার করেছিল। প্রথম বার তাঁকে গ্রেফতার করা হয় গত বছরের অগস্টে। তার পরে অন্য মামলাতেও তাঁকে অভিযুক্ত করে চলতি বছরের মে মাসে গ্রেফতার করা হয়।
প্রসন্নের তরফে আইনজীবী মুকুল রোহতগি যুক্তি দেন, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় প্রসন্নকে ২০২২-এর অগস্ট মাসে সিবিআই গ্রেফতার করে। সিবিআই অক্টোবরে চার্জশিট দায়ের করে। কিন্তু অন্যান্য অভিযুক্তদের কাঠগড়ায় তোলার অনুমতি না মেলায় চার্জশিট গৃহীত হয়নি। দ্বিতীয় মামলাতেও চলতি বছরের মে মাসে প্রথমে চার্জশিট, তার পরে অতিরিক্ত চার্জশিট দায়ের হয়েছে। কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা। এ দিকে প্রসন্ন এক বছরের বেশি সময় জেলে আটকে রয়েছেন।
সিবিআই প্রসন্নের জামিনের প্রবল বিরোধিতা করে। কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বিক্রমজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্তি দেন, প্রসন্ন ‘মিডলম্যান’ হিসেবে কাজ করতেন। তিনি প্রভাবশালী। জামিন পেলে তদন্তে ধাক্কা লাগতে পারে। সিবিআইয়ের এই যুক্তি শুনেই বিচারপতি সি টি রবিকুমার ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ প্রশ্ন তোলে, কেন রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না? বিচারপতিরা বলেন, তাঁরা এই সব প্রশ্ন লিখিত রায়ে লিখতে চান না। তাতে তদন্তে প্রভাব পড়বে। কিন্তু রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার না করে কেন যাঁদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের জেলে আটকে রাখা হচ্ছে, তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তোলে। সব অভিযুক্তকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি, তানিয়েও বারবার প্রশ্ন তোলেন বিচারপতিরা।
সিবিআইয়ের অভিযোগ অনুযায়ী, প্রথম জীবনে রংমিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করে নিয়োগ দুর্নীতির হাত ধরেই নিউ টাউনে ফ্ল্যাট, চর্মনগরী এলাকায় ভিলা-র মালিক হয়ে ওঠেন প্রসন্ন। তদন্তকারীরা তাঁর সাড়ে চারশোর বেশি সম্পত্তির হদিস পেয়েছিলেন। একের পর এক গাড়ি কিনে গাড়িভাড়া দেওয়ার ব্যবসাও শুরু করেন। রাজ্যের শিক্ষা দফতরকেও তিনি গাড়ি ভাড়া দিতেন।
প্রসন্নের আইনজীবী শাম্ব নন্দী উল্লেখ করেন, প্রসন্নের সংস্থায় কয়েক জনের থেকে চেকে টাকা জমা পড়েছে বলে সিবিআই অভিযোগ তুলেছে। কিন্তু সেই টাকা হাতবদল হয়ে অন্য কারও কাছে গিয়েছে, তা সিবিআই দেখাতে পারেনি। অথচ সিবিআই প্রসন্নকে ‘মিডলম্যান’ হিসেবে দাবি করছে। ঘুষের টাকা কেউ চেকে নেয় কি না, এ দিন আদালতে সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছে।
প্রসন্নের আর এক আইনজীবী অনির্বাণ গুহঠাকুরতা বলেন, ‘‘সিবিআই চার্জশিট দায়ের করলেও কী অভিযোগ রয়েছে, সেটাই প্রসন্নকে জানানো হয়নি।’’
সুপ্রিম কোর্ট আজ নবম-দশমের শিক্ষক ও গ্রুপ ডি নিয়োগ, দু’টি দুর্নীতির মামলাতেই প্রসন্নকে জামিন দিয়ে বলেছে— নিম্ন আদালত প্রয়োজন মাফিক জামিনে কড়া শর্ত আরোপ করবে।