— নিজস্ব চিত্র
শিলচরের অফিসপাড়া, সদরঘাটের নরসিং স্কুলই আমার স্কুল। তিন পর্যায়ের ক্রমিক উত্তরণে স্কুলটি এখন উচ্চ মাধ্যমিক। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত নরসিং এমই স্কুল ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে উন্নীত হয় হাইস্কুলে। আর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস।
করিমগঞ্জ জেলার বৈঠাখাল চা-বাগান থেকে এসে নরসিং স্কুলে ভর্তি হই ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এই নির্বাচনের কারণ মূলত পারিবারিক আবেগ। নরসিং হাইস্কুলের প্রথম হেডমাস্টার সুরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী ছিলেন আমার মাতামহ। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই নানা সময়ে এই স্কুলে কাজ করেছেন, এখনও করছেন।
চা-বাগানের প্রকৃতি সংলগ্ন শান্ত জীবন থেকে শহরের ব্যস্ত ভিড়াক্রান্ত পরিবেশে এসে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে ক্লাস ফোর থেকে টেন—মোট সাতটি ক্লাস। প্রতি ক্লাসে দু’টি বা তিনটি করে সেকশন। প্রচুর ছাত্র, অনেক শিক্ষক। সব মিলিয়ে হাবাগোবা এই গ্রামীণ বালককে নরসিং হাইস্কুল বিস্মিত ও কুণ্ঠিতই করেছিল। এই জড়তা থেকে মুক্ত করেছিলেন শিক্ষকরাই। উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্ব-ক্ষেত্র বাছাই করে নিতে। এই স্কুলই নির্মাণ করে দিয়েছে জীবনের ভিত। স্কুলে আমাদের শেখানো হয়েছিল একটা বীজমন্ত্র—‘থ্রি-আর’, অর্থাৎ রিড-রিপিট-রিভাইজ। এই মন্ত্রের আশ্চর্য শক্তি আজও অনুপ্রাণিত করে।
নরসিং স্কুল একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পড়াশোনা, খেলাধূলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, সমাজসেবা—সব ক্ষেত্রেই আমার স্কুল অনন্য। স্কুলের অনেক মেধাবী প্রাক্তনী নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। খেলাধূলায় নরসিং স্কুলের সুনাম আজও অক্ষুণ্ণ।
কাছাড় জেলার প্রথম সংবাদ পাক্ষিক ‘শিলচর’ (১৮৯৪)-এর সম্পাদক ছিলেন এই স্কুলের শিক্ষক বিধুভূষণ রায়। স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন এই অঞ্চলের প্রথম মৌলিক-সামাজিক উপন্যাস, ‘নারীশক্তি বা অশ্রুমালিনী’ (১৯২৫)। ১৯৩৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে স্কুল ম্যাগাজিন ‘ঝঙ্কার’। অনেক শিক্ষক ও ছাত্র নিরলস প্রচেষ্টায় আজও রক্ষা করে চলেছেন সেই ধারাবাহিকতা। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে উদ্যাপিত
হয়েছে স্কুলের শতবর্ষ। শতবার্ষিকী স্মরণিকায় বিধৃত হয়েছে গর্ব করার মতো এই সব তথ্য।
আমরা তখন নীচু ক্লাশের ছাত্র। সেই সময়, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে হেডমাস্টার হয়ে এলেন প্রেমেন্দ্রমোহন গোস্বামী। ব্যতিক্রমী ধারার এই শিক্ষাব্রতীর আগমনে স্কুলে লাগল পরিবর্তনের ছোঁয়া। ইংরেজি ‘এইচ’ হরফের আকৃতির স্কুলবাড়ির নানা জায়গায় টাঙানো হল মহাপুরুষদের বাণী লেখা বোর্ড। স্কুল শুরুর প্রার্থনা সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত হল সমবেত শপথ গ্রহণ। শপথের সূচনা বাক্যটি ছিল—‘আমি ভারতবাসী, ভারতবর্ষ আমার দেশ।’ প্রতিদিন এই শপথ পাঠ আমাদের মনে স্থায়ী ভাবে মুদ্রিত করেছে ভারত-চেতনা, জাগ্রত করেছে জাতীয়তাবোধ। প্রতি শুক্রবার একঘণ্টার টিফিনে হতো ‘মরাল টিচিং’-এর ক্লাস। আলোচিত হতো প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শনের নানা দিক। ছাত্রদের কথা বলা ছিল বাধ্যতামূলক। ভীতি ও জড়তা কাটিয়ে নিজস্ব শৈলীতে বক্তব্য উপস্থাপনের এই প্রশিক্ষণ কতজনকে যে জীবনপথে এগিয়ে দিয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই।
শিক্ষকদের নিষ্ঠা ছিল প্রশ্নাতীত। যে কোনও জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধানে টিচার্স রুমের দ্বার ছিল অবারিত। এই সূত্রেই শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠত স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি ছাড়িয়ে যা চিরকালীন বন্ধন তৈরি করত। অনেকের সঙ্গেই এই নির্মল সম্পর্ক আজও অটুট।
স্কুলের পরিসরে অবিস্মরণীয় কিছু ঘটনাও আছে। স্মৃতির ভাণ্ডারে যা কোনও দিনই মলিন হবে না। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের শিক্ষক জীবনের সূচনা হয়েছিল নরসিং স্কুলেই। কয়েকদিনের মধ্যে অতি প্রিয় হয়ে ওঠা তপোধীর স্যার কবিতা লেখেন, এই খবরও দ্রুত ছড়িয়ে গেল স্কুলে। পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আগে আমরা দল বেঁধে হাজির হলাম স্যারের কাছে। দাবি একটাই, নাটক লিখে দিতে হবে। কারণ স্ত্রী-ভূমিকা বর্জিত ভাল নাটক শিলচরে দুর্লভ। স্যার লিখলেন পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘ঋষি অরবিন্দ’। ছাত্র-শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াস। মহড়াও চলল ঠিকঠাক। নাম ভূমিকায় স্বয়ং তপোধীর স্যার। নাটকের একটা দৃশ্য ছিল: জেলের ভিতরে বন্দি ঋষি অরবিন্দের দীর্ঘ একক সংলাপ। আমরা কয়েকজন পাণ্ডা-ছাত্র মাথা খাটিয়ে সরু তারের উপর কালো কাগজ আঠা দিয়ে জুড়ে জেলের দরজা তৈরি করলাম। পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হালকা লালচে আলোর ব্যবস্থাও হল। পর্দা উঠতেই হাততালি। আমরাও অভিভূত। অরবিন্দের ভূমিকায় স্যার অস্থির হয়ে
পায়চারি করছেন। শুরু হল সংলাপ। আবেগের মাত্রা বাড়তেই স্যার গারদ ধরে যেই না ঝাকানি দিলেন পটপট করে ছিড়ে গেল সব কাগজ। আবারও হাততালি পড়ল—তবে তা মুগ্ধ বিস্ময়ে নয়...। স্কুলজীবনের এমন ঘটনা কি ভোলা যায়!