Internet

বক্তৃতাতেই স্মার্ট, নেট পরিষেবার বাস্তব ছবিটা কিন্তু করুণ

কোভিড আতঙ্কে শহরের আবাসন ছেড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সে এখন মেদিনীপুরে দেশের বাড়িতে। কিন্তু দেশের বাড়িতে মোবাইলের সিগন্যাল এই আছে তো এই নেই।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২০ ২০:৫০
Share:

এই মুহূর্তের পড়ুয়াদের বড় অংশের কাছে স্মার্টফোনের সুবিধা থাকলেও অনলাইন ক্লাসের জন্য নেই পর্যাপ্ত ইন্টারনেট স্পিড। ফাইল চিত্র।

সময়ের সঙ্গে বদলিয়েছে অনেক কিছুই। যেমন মধ্যবিত্ত। আগে তার বর্ণনায় থাকত তক্তপোশ আর বইয়ের কথা। এখন থাকে ছোট গাড়ি আর মলের গল্প। এই মধ্যবিত্ত ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে পড়ায়। আগে ছিল হিন্দু স্কুলের মতো ভাল বাংলা স্কুলে জায়গা খোঁজার লাইন। এখন তাঁরা সন্তানের জন্য ইংরেজি স্কুলের খোঁজ করেন। আর কোভিড কালে তাঁদের ছেলেরা ক্লাস করে অনলাইনে।

Advertisement

করতে চায়। কিন্তু পারে কি? এই রকমই মধ্যবিত্তের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকার কাছ থেকে সম্প্রতি গল্পটা শোনা। অনলাইনে ক্লাস করাচ্ছিলেন তিনি। এক ছাত্রের সঙ্গে আলোচনার সময়ে প্রচণ্ড আওয়াজে বিরক্ত হয়ে শিক্ষিকা তাঁকে বকেন। ছাত্রটি তখন ফোন ঘুরিয়ে দেখায়, কোথায় বসে সে স্কুল করছে। আর সেই জায়গাটা হল বাড়ির কাছে হাইওয়ে।

কোভিড আতঙ্কে শহরের আবাসন ছেড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সে এখন মেদিনীপুরে দেশের বাড়িতে। কিন্তু দেশের বাড়িতে মোবাইলের সিগন্যাল এই আছে তো এই নেই। তাই বেচারা রোদের মধ্যে ছাতা আর খাতা নিয়ে হাইওয়ে বাছতে বাধ্য হয়েছে ক্লাস করার জন্য।

Advertisement

মোবাইলে ইন্টারনেট স্পিড পেতে ঘরের ছাদে উঠে পড়াশোনা করছেন কেরলের এক পড়ুয়া।

স্বাধীনতা দিবসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আবারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গোটা দেশকে নেট পরিষেবায় মুড়ে দেওয়ার। তৎকালীন ইউপিএ সরকারের এই পরিকল্পনা ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে পাকাপাকি অনুমোদন পায়। ২০১৪ সালে এনডিএ সরকার গঠিত হলেও এই প্রকল্পে টেলিকম কমিশনের অনুমোদন জুটতে লেগে যায় আরও দুই বছর। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে এই প্রকল্পে টেলিকম কমিশনের পাকা ছাপ পড়ে। আর তারও চার বছর বাদে, যে মধ্যবিত্ত তাঁর সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে পারেন, তাঁকেও কিন্তু সন্তানের সঙ্গে গ্রামে থাকলে হাইওয়ের সন্ধান করতে হয় সিগন্যালের জন্য।

আরও পড়ুন: ‘জঙ্গলরাজ’-এর চূড়ায় যোগী রাজ্য, পরপর ধর্ষণ-খুন নিয়ে তোপ রাহুল-প্রিয়ঙ্কার

কিন্তু ফেরা যাক সরকারের দাবি এবং তা পূরণ করতে সদিচ্ছার গল্পে। পরিকল্পনা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে, দেশের কমবেশি সাড়ে ছয় লক্ষ গ্রামেই পৌঁছিয়ে যাবে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক। কাজ হবে তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে এক লক্ষ গ্রাম পঞ্চায়েতে, পরের ধাপে বাকি সবকটিতে।

তৈরি হয় ভারত ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক লিমিটেড। এই সংস্থারই দায় দেশ জুড়ে তার ফেলার, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে নেট দুনিয়া অধরা না থাকে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে যায় ২০১৭ সালেই। এক লক্ষ পঞ্চায়েত লক্ষ্য ছিল। দাবি অনুযায়ী, এই পর্যায়ে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ২০৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতে পৌঁছিয়ে গিয়েছে ভারত নেট। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে বাকি ১ লক্ষ ২৯ হাজারের মতো গ্রাম পঞ্চায়েতে পৌঁছনোর লক্ষ্য।

এখনও দেশে গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গায় মেলে না ইন্টারনেট পরিষেবা।

আর তার পরেই মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের নেট যাত্রার সারথি। এই তথ্য আপনি ভারত নেটের সাইটে গেলেই পাবেন। কিন্তু সাবধানে খুলবেন। দেশের মূল তথ্যবাহকের কাজ যার হাত দিয়ে হচ্ছে তার সাইটে গেলেই কিন্তু মিলবে সাবধান বাণী। ‘সাইট সুরক্ষিত নয়!’ ভাবুন একবার। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির গঙ্গাকে বহন করার দায় যে ভগীরথের ঘাড়ে, তার সাইটই সুরক্ষিত নয়!

ফিরি মূল প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালে যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল সে লক্ষ্য যে প্রধানমন্ত্রীর মুখনিসৃত, সেই একই প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীকে জানিয়েছেন আর তিন বছরের (১০০০ দিন) মধ্যেই সব গ্রামে ভারত নেট পৌঁছিয়ে যাবে।

কোথায় ঠেকছে? এই নিয়ে আরও আর-চারটে বিষয়ের মতো সরকারের কাছ থেকে কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় ব্রডব্যান্ড মিশনের আওতায় রয়েছে ভারত নেট। কিন্তু ভারত নেটের হাত ধরেই এই প্রকল্পটি হবে এবং বেসরকারি সংস্থার কোনও ভূমিকা মূল সংস্থা হিসাবে এই মিশনে থাকবে না, তা কিন্তু কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই।

ভারত নেট চলবে কার টাকায়? এর জন্য তৈরি হয়েছে ইউনিভার্সাল সার্ভিস অবলিগেশন তহবিল। তার টাকা আসছে টেলিকম সংস্থাগুলির আয়ের উপর আলাদা সেস বসিয়ে। অভিযোগ, প্রাথমিক অনুমানে ২০ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটির তার পাতার দায় বিএসএনএল-সহ যে দু’টি সংস্থার ঘাড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই দু’টি সংস্থাই তাদের কাজের দায় সময়ে মেটাতে পারেনি বলে গোটা কাজটি পিছিয়ে গিয়েছে।

তবে এই মিশনে যে ভারত নেটের একচ্ছত্র আধিপত্য নেই, তা পরিষ্কার পাঞ্জাব ও বিহারের সিদ্ধান্ত থেকে। এই দুটি রাজ্যই কিন্তু বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে এই মিশনের লক্ষ্য মেটাতে। মাথায় রাখতে হবে, প্রথম পর্যায়ের পরের অধ্যায়ের কাজের আর্থিক দায়ের ৩০ শতাংশের উপর বর্তিয়েছে রাজ্যগুলির উপর।

তবে অভিযোগের পাহাড় জমছে, যে সমস্ত গ্রামে এই নেটওয়ার্ক পৌঁছিয়েছে সেখানে ইন্টারনেটের যোগাযোগ নিয়ে। নিয়মিত নেট কাজ না করার অভিযোগই প্রধান। অর্থাৎ যে গ্রামে এই নেট সংযোগ পৌঁছিয়েছে তারা কিন্তু এখনও সেই তিমিরেই।

আরও পড়ুন: বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যেই, খতিয়ে দেখবে সুপ্রিম কোর্ট

এই মিশনের মূল ভাবনাটাই ছিল, গ্রামে গ্রামে নেট সংযোগ পৌঁছিয়ে দিয়ে চিকিৎসা থেকে শিক্ষা ও নানান সরকারি কাজকে সাধারণ নাগরিকের কাছে সহজলভ্য করে তোলা। কিন্তু সরকার যাই দাবি করুক না কেন, প্রকল্পের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন যতই সুন্দর হোক না কেন, তার প্রয়োগও কিন্তু সেই তিমিরেই, যে অন্ধকারে স্বাধীনতার পরেও নাগরিক থাকতে অভ্যস্থ। গরিবের কথা বাদ দিই। মধ্যবিত্তের কাছেও কিন্তু নেট সহজলভ্য নয়, স্থান যদি একটু প্রত্যন্ত হয়। সন্তানকে স্মার্ট ফোন কিনে দিলেও নেটের খোঁজে সেই হাইওয়েই এখনও ভরসা। এত দিন অপেক্ষা করা গিয়েছে। আরও তিন বছর কেটে যাবে। প্রশ্ন শুধু একটাই, গ্রামে গ্রামে নেট সত্যিই সহজলভ্য হবে তো? কী ভাবে তার উত্তর কিন্তু এখনও অধরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement