উত্তরকাশীতে এই সুড়ঙ্গের একাংশ ভেঙেই বিপর্যয় ঘটেছে। —ফাইল চিত্র।
দিন-রাত এক করে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের উদ্ধার করেছেন পেশায় তাঁদেরই মতো শ্রমিক ওয়াকিল হাসান, মুন্না কুরেশিরা। ওঁরা তাই ঠিক করেছেন, এই উদ্ধারকাজের জন্য একটি টাকাও নেবেন না। ৪১টি পরিবারের মুখের হাসিই তাঁদের পুরস্কার।
আমেরিকান অগার মেশিন ভেঙে গিয়েছে সুড়ঙ্গে। সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় প্রচেষ্টাও তখন বিফলে যাওয়ার মুখে। এমনই এক সময়ে সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারে নামেন মুন্না, ওয়াকিল, কুমারের মতো র্যাট হোল মাইনার-রা। উদ্ধারকাজের শেষ ধাপে তাঁদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমই খেলা ঘুরিয়ে দেয়। দানবীয় যন্ত্র হেরে যায় মানুষের হাতের কাছে।
রাজধানীর নিকাশি নালায় জমে কঠিন হয়ে যাওয়া বর্জ্য সরানোর মতো কাজ করে হাত পাকিয়েছেন দিল্লির দাঙ্গা-পীড়িত খজুরী খাস এলাকার মুন্নারা। গুটিসুটি মেরে কোনও মতে ঢোকা যায়, এমন সংকীর্ণ জায়গায় বসে ওঁরা হাতের যন্ত্র চালিয়ে কাজ করেন। ঠিক যে ভাবে কোনও কোনও খনি এলাকায় ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বিপজ্জনক ও বেআইনি ভাবে খনিজ পদার্থ কেটে আনেন কেউ কেউ। মুন্নারা বৈধ ও পেশাদার ‘র্যাট হোল মাইনার’। তাঁদের দক্ষ হাত ও অভিজ্ঞতা মাত্র ২৬-২৭ ঘণ্টাতেই অসাধ্য সাধন করে। উত্তরকাশীতে উদ্ধারকাজের সব বিকল্প যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন কাজে লেগে যায় এই পদ্ধতিটাই।
দিল্লি থেকে যাওয়া দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াকিল হাসান। তাঁর কথায়, ‘‘শনিবারের মধ্যেই আমরা সুড়ঙ্গের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাঙা অগার যন্ত্র কেটে বার করতে সমস্যা হচ্ছিল। সেই কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হয়। সোমবার বেলা ৩টে নাগাদ ১২ জনের দলটি দফায় দফায় কাজ শুরু করে। পরের দিন সন্ধ্যা ৬টা-৭টার মধ্যে ‘ব্রেক-থ্রু’ হয়।’’ অর্থাৎ, পাইপ পৌঁছে যায় শ্রমিকদের কাছে।
আটকে থাকা শ্রমিকদের প্রথম যিনি চাক্ষুষ করেন, তিনি মুন্না। বলেন, ‘‘প্রথম দিকে খাওয়ার জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। কিন্তু শেষের কয়েক ঘণ্টায় বিশ্রাম না নিয়ে একটানা কাজ করে গিয়েছি।’’ শেষ পাথরটা সরাতেই শ্রমিকদের দেখতে পেয়ে মুন্না লাফ দিয়ে ও-প্রান্তে চলে যান। মুন্নাকে দেখে তাঁকে আনন্দে জাপটে ধরেন গব্বর সিংহ নেগি-সহ অন্য শ্রমিকেরা। টানা কাজ করে হাঁফিয়ে যাওয়া মুন্নাকে দেওয়া হয় জল-বাদাম। শ্রমিকেরা বুঝে যান, উদ্ধার এখন সময়ের অপেক্ষা।
সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষ হয়েছে শুনে চূড়ান্ত পর্বের উদ্ধারকাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ)। মুন্নাদের তৈরি সুড়ঙ্গে বসানো পাইপলাইন দিয়ে একে একে পৌঁছন তাদের উদ্ধারকারীরা। মুন্নারা শ্রমিকদের বিদায় জানিয়ে ফিরে আসেন। তখন ওঁদের গোটা শরীর, মাথার চুল থেকে চোখের পাতা ধুলোয় ভর্তি। কিন্তু মুখে যুদ্ধ জয়ের অনাবিল হাসি। ওই দলের আর এক সদস্য কুমার এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশ থেকে। তাঁর কথায়, ‘‘ঐতিহাসিক এই উদ্ধার অভিযানে শামিল হতে পেরে আমি ও আমার গোটা দল গর্বিত।’’
সাধারণত মেঘালয় বা ঝাড়খণ্ডের খনি অঞ্চলে ইঁদুরের গর্তের মতো বেআইনি ‘র্যাট হোল মাইনিং’ দেখা যায়। গর্তগুলিতে অধিকাংশ সময়ে কোনও ঠেকনা না থাকায় মাঝেমধ্যেই ধস নেমে মারা যান খননকারীরা। তাই বেশ কয়েক বছর আগে ‘র্যাট হোল মাইনিং’ বন্ধ করে দেয় জাতীয় পরিবেশ আদালত। কিন্তু সেই দেশীয় পদ্ধতিই উত্তরকাশীতে প্রাণ বাঁচাল ৪১ জনের। বাইরে মুক্ত হয়ে আসা শ্রমিকদের দেখে এনডিআরএফের এক কর্তার সহাস্য উক্তি, ‘‘আমেরিকান মেশিন ব্যর্থ। ভারতীয় ‘জুগাড়’ (কাজ চালানো পদ্ধতি) কিন্তু সফল। ভারতীয়দের জুগাড়ের কোনও বিকল্প নেই।’’