রাহুল গাঁধী নিজেকে বদলে ফেলেছেন। দলে নবীন ও প্রবীণদের মধ্যে সংঘাতের অবসান ঘটাতে এখন তৎপর তিনি। পাল্টে ফেলেছেন জোট রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর পুরনো আপত্তিও। এ বার দলের শীর্ষ পদে অভিষেক ঘটতে চলেছে তাঁর। শেষ মুহূর্তে কোনও বাধা উপস্থিত না হলে, জানুয়ারি মাসেই কংগ্রেস সভাপতি হতে চলেছেন তিনি।
অনেক সময়ে রাজনীতিতে প্রত্যাশিত ঘটনাও ঠিক কখন বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যায়। এ বার কিন্তু কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি সেই ধোঁয়াশা কাটিয়ে রাহুল গাঁধীকে সভাপতি করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে চলেছে।
২০১৩-র জানুয়ারির এক শীতের সকালে, জয়পুরের বিড়লা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অডিটোরিয়ামে ওয়ার্কিং কমিটি তাদের চিন্তন বৈঠকের পরে রাহুল গাঁধীকে দলের সহ-সভাপতি ঘোষণা করেছিল। তখন মনমোহন সিংহ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল একেবারেই আলাদা। আর এখন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাসীন। এই পরিস্থিতিতে সনিয়া গাঁধী নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রাহুলকেই এগিয়ে দিচ্ছেন।
গত বছরেই সভাপতির পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন সনিয়া। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে শেষ পর্যন্ত এক বছর ওই পদে থেকে যেতে রাজি হন তিনি। আগামী জুলাইয়ে শেষ হচ্ছে তাঁর পদের মেয়াদ। তার পর আর দায়িত্ব নিতে নারাজ সনিয়া। সুতরাং রাহুল। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ যে ক্রমেই রাহুলের হাতে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত মিলছে বিভিন্ন ঘটনায়। যেমন বিহারে নীতীশ কুমারের শপথে নিজে না-গিয়ে রাহুলকে পাঠিয়েছিলেন সনিয়া। তার পর চিকিৎসার প্রয়োজনে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছেন তিনি। আর অসহিষ্ণুতা, পণ্য-পরিষেবা কর নিয়ে বিতর্কে সংসদে কংগ্রেসের ভূমিকা কী হবে, তা ঠিক করছেন রাহুল।
ফলে ১৯৯৮ থেকে টানা ১৭ বছর কংগ্রেসের সভাপতি থাকা সনিয়ার কাছ থেকে নেতৃত্বের হাতবদলের প্রক্রিয়া নিঃশব্দে শুরু হয়ে গিয়েছে। জানুয়ারিতে রাহুলকে সভাপতি ঘোষণার পরে সেই নেতৃত্বকে জোরালো ভাবে আমজনতার সামনে প্রতিষ্ঠা করার কথাও ভাবা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই একাধিক রাজ্যে বিধানসভা ভোট। প্রথম পর্বে অসম, পশ্চিমবঙ্গে এবং কেরলের বিধানসভা নির্বাচন। তার পর রয়েছে পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ। কংগ্রেস নেতারা ভাবছেন, তার আগে রাহুলকে সভাপতি ঘোষণা করলে অক্সিজেন পাবেন নেতা-কর্মীরা।
সভাপতি ঘোষণার সম্ভাব্য তারিখ, দিন ক্ষণ নিয়ে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলছে। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে জানুয়ারির ১৫— এই এক মাস সাধারণত শুভ কাজ করতে দ্বিধায় থাকেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। তাই ১৫ জানুয়ারির পরেই দলের সভাপতি হিসেবে রাহুলের নাম ঘোষণার সম্ভাবনা।
সনিয়া গাঁধীর জায়গায় রাহুলকে মেনে নিতে গোড়া থেকেই কংগ্রেসের অনেক প্রবীণ নেতার সমস্যা ছিল। আহমেদ পটেল, জনার্দন দ্বিবেদীর মতো নেতারা রাহুলকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকতেন। সনিয়া ঘনিষ্ঠ এই দুই নেতা অতীতে নিজেদের মধ্যে অনেক ঝগড়া করেছেন। কিন্তু রাহুলের উপর চটে গিয়ে একজোট হয়েছিলেন তাঁরা। তবে এখন তাঁরাও বুঝতে পারছেন, রাহুলই কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ। সনিয়া-ঘনিষ্ঠ প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এ কে অ্যান্টনি তো সরাসরিই বলেছেন, রাহুলকে অবিলম্বে সভাপতি করা হোক। প্রিয়ঙ্কাকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার দাবিতে যে আওয়াজ উঠেছিল এখন তা-ও আর নেই।
আর এই প্রেক্ষাপটে নিজের ভাবনাতেও অনেক বদল এনেছেন রাহুল। যেমন দলে নবীন ও প্রবীণদের সংঘাত পর্ব মিটিয়ে ফেলেছেন তিনি। বদলেছেন রাজনীতিতে ‘একলা চলো’-র ভাবনাও। দলে প্রবীণদের গোষ্ঠীর সঙ্গে টিম রাহুল— অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত তরুণ রাহুল-অনুগামীদের মধ্যে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। দলীয় নেতাদের কিছু না জানিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে রাহুল যখন ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান, তখন দলের মধ্যে আরও জলঘোলা শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে কিছু নেতা রাহুলের জায়গায় অন্য কাউকে সামনে আনার চেষ্টাও চালান। মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেস কমিটি গঠনের পর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কমল নাথ ও দিগ্বিজয় সিংহ। তাঁদের ঘনিষ্ঠ বহু নেতাকেই কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আনেন। মধ্যপ্রদেশের ভোটে ব্যর্থ হওয়ার পরেও রাজ্য সভাপতি অরুণ যাদবকে না-সরানোর সিদ্ধান্তে প্রবীণ নেতাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ব্যপম কেলেঙ্কারির মতো বিষয়কে দল কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগের আঙুল তোলা হয় টিম রাহুলের দিকে।
হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডাও প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির পুনর্গঠন নিয়ে একই ভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র রুপিন্দর সিংহ হুডা রাহুল, প্রিয়ঙ্কা ও রবার্টের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ক্ষুব্ধ ভূপেন্দ্র হরিয়ানায় কিষান সমাবেশ করে হাইকম্যান্ডের সামনে শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। একই ঘটনা দেখা যায় ছত্তীসগঢ়েও। সেখানে হতাশ ও ক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতা অজিত জোগী কিছুতেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী না হতে পারায় বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপে সক্রিয় হন। পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহ রাজ্য সভাপতি প্রতাপসিংহ বাজোয়াবিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে গিয়ে হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে চলে যান। পৃথক দল গড়ার কথাও বলতে শুরু করেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে তো বলেই বসেছিলেন, কংগ্রেসের বাইরে একটা বিকল্প ভাবার সময় এসেছে।
এই অবস্থায় এপ্রিলে দেশে ফিরে নতুন ইনিংস শুরু করেছেন রাহুল। তাঁর প্রধান সচিব কণিষ্কের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে টিমেও রদবদল করেছেন। ভোটের সময় যে টিম বৃদ্ধতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আধুনিক কায়দায় ডিজিট্যাল কৌশল রচনা করছিল, তার বেশির ভাগ সদস্যকেই সরিয়ে প্রবীণদের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। পঞ্জাবে অমরেন্দ্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজস্থানে সচিন পায়লট সক্রিয় হলেও সি পি জোশী ও অন্য প্রবীণ নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে মানভঞ্জন করা হয়েছে। এমনকী দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের বাড়ি গিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করেন রাহুল। আলোচনা শুরু করেছেন আহমেদ পটেলের সঙ্গেও।
আসলে প্রবীণ নেতারা বুঝেছেন, নেহরু-গাঁধী পরিবারের অভিভাবকত্ব থেকে দলকে মুক্ত করা অসম্ভব। রাহুলও বুঝতে পারছেন, দল চালাতে গেলে আপস করতে হবে। তাই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যখন অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান, বিহার-মধ্যপ্রদেশ-গুজরাতে ভোটের ফলে কংগ্রেসের পালে সামান্য হলেও সাফল্যের হাওয়া— তখনই সভাপতি পদে রাহুলকে আনার উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন সনিয়া। তবে প্রবীণদের একটি অংশ বলছেন, রাহুল সভাপতি হলেও প্রধান উপদেষ্টা বা সমপর্যায়ের পদ দিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রাখা হোক সনিয়াকেই।