—ফাইল চিত্র
ছাপ্পান্ন দিনের ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরলেন রাহুল গাঁধী।
উপর্যুপরি ভোট ভরাডুবির পরে কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা যখন প্রশ্নের মুখে, তখন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎই অজ্ঞাতবাসে চলে যান দলের সহ-সভাপতি। ব্যাপারটা নজরে পড়ে তিন দিন পরে। সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে হইচই হতেই কংগ্রেস জানায়, দলকে দিশা দেখানোর আগে আত্মমন্থন করতে চান রাহুল। কংগ্রেসের সাংগঠনিক পুনর্গঠনের আগে একান্তে চিন্তা-ভাবনা করতে চান তিনি। তাই সভানেত্রীর অনুমতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন।
সেই যে গিয়েছিলেন, আজ ফিরলেন রাহুল! কোথায় গিয়েছিলেন, এত দিন কী করছিলেন, সে বিষয়ে কংগ্রেসের তরফে সে দিনও যেমন কিছু জানানো হয়নি, আজও নয়। তবে সেই ধোঁয়াশা সত্ত্বেও দলের একাধিক সূত্রের দাবি, বিপশ্যনা ধ্যান অনুশীলনের জন্য মায়ানমারে গিয়েছিলেন রাহুল। এত দিন সেখানেই ধ্যান ও অন্যান্য অনুশাসনের মধ্যে ছিলেন। কাল রাতে ইয়াঙ্গন থেকে ব্যাঙ্কক যান তিনি। সেখান থেকে তাই এয়ারওয়েজের উড়ানে আজ সকাল সওয়া ১১টায় দিল্লি ফেরেন।
রাজনীতি সরিয়ে রাখলে গাঁধী পরিবারের জন্য আজকের দিনটা ছিল নিতান্তই আবেগের। ছাপ্পান্ন দিন পরে ছেলে ঘরে ফিরছে! সকাল সাড়ে ৯টায় কালো ল্যান্ডরোভার গাড়ি চড়ে দশ নম্বর জনপথ থেকে বেরিয়ে ১২ নম্বর তুঘলক লেনে রাহুলের বাসভবনে পৌঁছে যান সনিয়া। কিছুক্ষণ পরে সেখানে আসেন প্রিয়ঙ্কা বঢড়াও। পরিবারের এ ধরনের কোনও মুহূর্তে এত দিন সনিয়া-জামাতা রবার্ট বঢড়াকেও দেখা যেত। আজ অবশ্য রবার্ট ছিলেন না। সম্ভবত বিতর্ক এড়াতেই জামাইয়ের ছায়া আজ সেখানে পড়তে দেননি সনিয়া।
তুঘলক লেনের বাড়িতে রাহুল পৌঁছনোর ঘণ্টা দুয়েক পরে সেখান থেকে তিন জনে বেরিয়ে আসেন। পারিবারিক সূত্রে খবর, মা-বোনের সঙ্গে দশ নম্বর জনপথে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ করেন রাহুল। বিকেলে নিজের বাড়ি ফিরে আসেন। আসা-যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও কথা না বললেও, গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে সেই প্রথম রাহুলকে দেখা যায়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নেই। ক্লিন শেভেন মুখ, গোল-গলা টি শার্টে একেবারে ঘরোয়া মুডে। কোলের ওপর দাপাচ্ছে পোষা দু’টি কুকুর।
কিন্তু এর পর?
সবুজে ঘেরা তুঘলক লেনের মনোরম পরিবেশ আর পরিবারের আবেগের বাইরে রুক্ষ রাজনীতির মাঠ যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, তা রাহুল জানেন! কংগ্রেস নেতাদের মতে, বিশ্রামের জন্য আপাতত আজকের দিনটাই শেষ সুযোগ পাবেন রাহুল। কাল থেকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা দিতে হবে তাঁকে। তাঁর অজ্ঞাতবাসের কারণ হিসেবে দলীয় তরফে বলা হয়েছিল, আত্মমন্থনের জন্য ছুটি নিয়েছেন তিনি। স্বভাবতই দলে সম্ভাব্য ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে কংগ্রেসের নিচুতলায় যেমন প্রত্যাশা রয়েছে, তেমনই দেশও দেখতে চায় রাহুলের আচরণে কী বদল হল! তিনি আগের মতোই ইতস্তত করছেন বা থতমত খাচ্ছেন, নাকি রাজনৈতিক ভাবে আরও পরিণত আচরণ করছেন বা মত প্রকাশ করছেন?
আগের থেকে তাই এখন অনেক বেশি নজর থাকবে রাহুলের পারফরম্যান্সের ওপর। বস্তুত আজ থেকেই তা শুরু হয়ে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া টুইটারে আজ সব থেকে আলোচিত বিষয় ছিল রাহুলের ঘরে ফেরা। সেখানে তাঁকে ঘিরে আজ দিনভর নানা টীকা-টিপ্পনিও চলেছে। আবার বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘‘রাজনীতিতে আইটেম নম্বরের জায়গা নেই। ছুটি থেকে ফিরে কে কবে মুখ খুলবেন, কে জানে! রাজনীতি করলে তা করতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা, বছর ভর!’’
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্যের কথায়, রাহুলের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ হল সর্বস্তরে হতাশাগ্রস্ত দলকে উজ্জীবিত করে তোলা। তিনি নিজেকে কী ভাবে উপস্থাপন করছেন, কী বলছেন তা সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসের সংগঠনকে আগের থেকে অনেক বেশি কার্যকর ও গতিশীল করে তোলা। আপাতত স্থির হয়েছে, খুব শীঘ্রই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে কংগ্রেসের অধিবেশনের দিন স্থির করা হবে। অর্থাৎ কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুলের কবে অভিষেক হবে, তার নির্ঘণ্ট স্থির হবে। কিন্তু সে ব্যাপারে দলের ভেতরেই বিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক উত্তরণে খোলাখুলি আপত্তি জানাচ্ছেন শীলা দীক্ষিত, অমরেন্দ্র সিংহের মতো প্রবীণ নেতারা। আজও কেরলের কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে ভি টমাস বলেন, ‘‘দলে প্রিয়ঙ্কা গাঁধীকে নিয়ে আসা উচিত।’’ আরও বাধার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু সে সব বাধা কাটিয়ে রাহুল কতটা কার্যকরী টিম গড়তে পারেন, সেটাই দেখার। তিনি যাঁদের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে চান, তাঁদের ব্যাপারে দলের নিচুতলায় দ্বিমত নেই। রাহুলের পছন্দের নেতারা যে আদৌ কাজের লোক নন, তা এত দিনে প্রমাণিত। নতুন টিম গড়ে এ বার সেই মিথটা ভাঙতে হবে রাহুলকেই।
দলের শীর্ষ নেতা দিগ্বিজয় সিংহের মতে, রাহুলের মধ্যে নিশ্চয় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে। তাঁর মতে, এখন থেকে সারা ক্ষণ রাজনীতিতেই ডুবে থাকতে হবে রাহুলকে। আগের থেকে অনেক বেশি কথা বলতে হবে। কারণ, রাহুল গাঁধী বলতে কী বোঝায়, সেটাই দেশের মানুষ ভাল করে জানেন না। রাহুল নিজেকে সে ভাবে তুলে না ধরার জন্যই এটা হয়েছে। এ বার রাহুলকে আরও বেশি রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে হবে, দেশকে জানাতে হবে শিল্পায়ণ সম্পর্কে তাঁর ধারনা কী, গরীব-কৃষকদের কল্যাণের জন্য তাঁর চিন্তা কতটা গভীর, অর্থনৈতিক বিষয়ে তাঁর কী মত, ইত্যাদি। দিগ্বিজয়দের মতে, রাহুল এই কাজটা ঠিকঠক করতে পারলেই তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবনা উধাও হয়ে যাবে।
সত্যিই কি তা পারবেন রাহুল? ছুটি কাটিয়ে দেশ ফেরার পর আগামী রবিবার দিল্লিতে কংগ্রেসের কৃষক সভায় প্রথম প্রকাশ্যে মুখ খোলার কথা রাহুলের। কংগ্রেস নেতাদের মতে, ইঙ্গিতটা সে দিনই পাওয়া যাবে।