‘যার করতল নেই সে কাকে ভিক্ষা দেবে...’
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পদ্যের অমোঘ পঙ্ক্তিটি কিছুটা ভিন্ন রূপে উঠে এল আজ ছাত্রদের সঙ্গে কংগ্রেস সভাপতির কথোপকথনে। রাহুল গাঁধীর বক্তব্য, গোটা দেশে ছড়িয়ে যাওয়া ঘৃণার আবহে প্রধানমন্ত্রীই পারতেন প্রেমের বার্তা দিতে। পারছেন না কারণ, মোদীর নিজেরই প্রেম নেই। আলিঙ্গনেও সাড়া দেয় না তাঁর শরীর, আড়ষ্ট হয়ে থাকে। কিছু দিন আগে নিজে মোদীকে আলিঙ্গন করে এ কথা বুঝেছেন, দাবি রাহুলের।
জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ছাত্রদের নিয়ে অনুষ্ঠানে এ দিন রাহুলের বক্তব্য, ‘‘লোকসভায় আলিঙ্গন করার সময় ওঁকে স্পর্শ করলাম। উনি এমন অবাক হলেন, যে এটা কী হল! কী করে হল! কেউ আমায় ভালবাসছে কী করে! আসলে বোধহয় ওঁর যে ভালবাসা পাওয়ার কথা ছিল, সেটা...!’’
তুমুল হাততালির মধ্যে ইচ্ছে করেই বাক্যটি শেষ করেননি রাহুল। কারণ তাঁর যা বোঝানোর ছিল, ততক্ষণে বোঝানো হয়ে গিয়েছে! এর পরই প্রধানমন্ত্রীর শরীরী ভাষা, আলিঙ্গনের ইতিবৃত্ত এবং প্রেমহীনতার অভিযোগ নিয়ে রাজধানীতে দানা বেঁধেছে গুঞ্জন। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর যে বিবিধ আলিঙ্গন কূটনৈতিক অভিধানে নতুন শব্দের (হাগ-ডিপ্লোম্যাসি) জন্ম দিল, সেই মোদীর শরীর কেন আড়ষ্ট হয় রাহুল গাঁধীর আলিঙ্গনে? সে কি রাহুল শুধু প্রতিপক্ষ বলে? মনস্তত্ত্ববিদ অনিন্দিতা রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘যার সঙ্গে সম্পর্ক খুবই শীতল এবং বৈরীভাবাপন্ন সে ক্ষেত্রে শরীর সাড়া দেয় না। রাহুল-মোদীর আলিঙ্গনে মোদীর দিক থেকে সেটাই সম্ভবত ঘটেছে।’’
রাহুল কিন্তু ছাত্রদের বলছেন, ‘‘মোদী আমার পরিবারের বিরুদ্ধে একের পর এক কথা বলে গিয়েছেন। আর আমি তাঁকেই জড়িয়ে ধরেছি। তাঁর মনে ঘৃণা থাকতে পারে আমার নেই। এটা একটা জাদু।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই ঘটনা নিয়ে খোদ মোদী পরে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘‘আলিঙ্গন করা আর ঝাঁপিয়ে পড়া দু’টো আলাদা জিনিস!’’ অনেকের প্রশ্ন, তা-ই যদি হবে, তা হলে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব আলিঙ্গন করলেও মোদীর মুখে ‘বিরক্তি’ ফুটে ওঠে কেন!
আরও পড়ুন: ‘রুটিন’ অভিযান ঘিরে আতঙ্ক বাড়ছে কাশ্মীরে
লোকসভায় আলিঙ্গন করার সময় স্পর্শ করলাম। উনি অবাক হলেন... কেউ আমায় ভালবাসছে কী করে! : রাহুল গাঁধী
মোদীর সঙ্গে আলিঙ্গনের অভিজ্ঞতার বিপরীতে আর একটি অভিজ্ঞতার কথা এ দিন উল্লেখ করেছেন রাহুল। তাঁর কথায়, ‘‘আমি যখন খুব ছোট, মা বকলে ঠাকুমার পিছনে লুকোতাম। সেই ঠাকুমা যখন ৩২টি বুলেটের আঘাতে মারা গেলেন, অসম্ভব রাগ হয়েছিল। যে মেরেছে সেই সতবন্ত সিংহ তো ছিল আমার বন্ধু! আমায় ব্যাডমিন্টন খেলা শিখিয়েছিল। বাবা তখন বাংলায়। ফিরে এসে আমায় যখন জড়িয়ে ধরলেন, এক লহমায় আমার সব রাগ পড়ে গেল। এ হল সেই আলিঙ্গন, যাতে ঘৃণা আর ক্রোধ কমে যায়।’’
রাষ্ট্রনেতার আলিঙ্গনে পিতার স্নেহ অবশ্য প্রত্যাশিত নয়। মনস্তত্ত্ববিদ ঝুমা বসাকের মত হল, ‘‘একজন রাষ্ট্রনেতা যখন অন্যকে জড়িয়ে ধরেন তখন তার পিছনে বহুস্তরী কারণ থাকে। কৌশলগত, রাজনৈতিক, পেশাদারি।’’ বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী যদি তাঁর আলিঙ্গনকে পেশাদারিত্বের স্তরেই বেঁধে রাখতেন, কিছু বলার ছিল না। কিন্তু ঘন ঘন আলিঙ্গনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্কের যে আভাস তিনি দিতে চান, তা অনেক সময়েই মেকি।
মোদীর আলিঙ্গনে কূটনৈতিক ফায়দা কতটুকু? পক্ষে, বিপক্ষে দু’রকম মতই আছে। কেউ কেউ বলেন, এর মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে চটজলদি একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতে পারেন মোদী। সেই সঙ্গে দেশে সমর্থকদের মধ্যেও তাঁর ৫৬ ইঞ্চির বিজ্ঞাপন অনেক তাগড়া হয়। সমালোচকদের আবার অভিমত, সবাই যে এই ধরনের আলিঙ্গনকে ভাল চোখে দেখেন, এমন নয়! বিদেশের অনেক সংবাদমাধ্যমে মোদীর এই আচরণ নিয়ে বাঁকা মন্তব্য দেখা গিয়েছে।