নিশানায় সরকার। বুধবার লোকসভায় রাহুল গাঁধী। ছবি: পিটিআই
গত কয়েক দিন ধরে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছিলেন তিনি। ‘সেকেন্ড ডাউন’ নামবেন না ‘থার্ড ডাউন’, তা নিয়েও খানিক ধন্দ ছিল কংগ্রেসে। শেষমেশ স্লগ ওভারে নেমে আজ ‘মোদী-ইলেভেনের’ বিরুদ্ধে ঝোড়ো ব্যাটিং করলেন রাহুল গাঁধী!
জেএনইউ বিতর্ককে সামনে রেখে বিজেপি-আরএসএস যখন উগ্র জাতীয়তাবাদের মধ্যে দিয়ে ভরপুর মেরুকরণের খেলায় নেমেছে, তখন সবাইকে ছেড়ে রাজনৈতিক সমালোচনায় আজ মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বেছে নেন রাহুল। তার পর নিজস্ব কায়দায় কখনও টিপ্পনী করেন মোদীকে। ঠিক যে ভাবে স্যুট-ব্যুটের সরকার বলে এক সময় করেছিলেন। কখনও গুরুতর অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তার পর রোহিত ভেমুলা ও জেএনইউ বিতর্কের প্রসঙ্গ টেনে রাহুল বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীজি ভুল করছেন। শুধু তাঁর একার মতে দেশ চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী মানেই দেশ নয়, দেশ মানে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন। দেশ চালাতে গেলে সকলের মত শুনতে হবে। দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটাকে ধ্বংস করে দিয়ে তিনি জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলতে পারেন না।’’
সংসদে গত কয়েকটি অধিবেশন ধরেই সক্রিয় রাহুল। এ বারও জেএনইউ বিতর্কে তিনি যে সংসদে সরকার বিরোধিতায় সরব হবেন তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু উপযুক্ত সময়ের খোঁজে ছিলেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি। যাতে বাজেট বিতর্কের মাঝে তাঁর মত হারিয়ে না যায়। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে মোদী-আরএসএসের বিরুদ্ধে আজ ঝলসে ওঠার চেষ্টা করেন রাহুল।
শুরুটা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মস্করা দিয়েই। সংসদে বক্তৃতা দেওয়ার পুরনো জড়তা ইতিমধ্যেই বেশ কাটিয়ে ফেলেছেন রাহুল। আজ লোকসভায় এসেছিলেন একেবারে ‘ক্লিন শেভেন’ হয়ে। কংগ্রেস সহ-সভাপতি গোড়াতেই বলেন, ‘‘এ বার বাজেটে দেখলাম সরকার ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি প্রকল্প শুরু করেছে। কালো টাকা সাদা করার প্রকল্প। মোদীজি সরকারে আসার আগে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি দমন করবেন। কালোকারবারিদের ধরে ধরে জেলে পুরবেন। কিন্তু কোথায় কী! সব ভোঁ ভাঁ! উল্টে দেখছি কালো টাকা সাদা করার সরকারি ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী!’’ রাহুলের কথায়, ‘‘মানুষও বুঝে গিয়েছে কথার খেলাপ করায় নরেন্দ্র মোদীর জুড়ি নেই। ভোটের আগে বলেছিলেন, ডাল সস্তা হয়ে যাবে। অথচ ডাল আগে ছিল ৭০ টাকা কেজি এখন হয়েছে দু’শো টাকা কেজি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে, অথচ এক নয়া সুবিধাও মানুষ পায়নি। বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে বছরে দু’কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু তার কোনও পরিসংখ্যানই সরকার দিতে পারছে না।’’ রাহুলের দাবি, ‘‘এই সংসদে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, একশো দিন কাজের প্রকল্প তিনি বন্ধ করবেন না। কারণ তা কংগ্রেসের ব্যর্থতা জানান দিয়ে যাবে। কিন্তু এ বার বাজেটে যা শুনলাম, তাতে ধন্দ হচ্ছিল অরুণ জেটলি বক্তৃতা দিচ্ছেন না চিদম্বরম!’’ এর পর জেটলিকেও অস্বস্তিতে ফেলে দেন রাহুল। বলেন, ‘‘জেটলিজি আমার কাছে এসেছিলেন। বলছিলেন, একশো দিনের কাজ দারুণ প্রকল্প। আমি ওঁকে বলি, এ কথা আপনার ‘বস’কে বলছেন না কেন? জবাব দিতে পারেননি অর্থমন্ত্রী!’’
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই সব টিপ্পনী কাটার পরেই রাহুল আজ সরাসরি রোহিত ভেমুলা ও জেএনইউ বিতর্কের প্রসঙ্গে চলে যান। অভিযোগ করেন, দলিত, অনগ্রসর ছাত্রদের স্বর দমন করতে রাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার করছে সরকার। তাঁর মন্তব্য, ‘‘মোদীজি খুব শক্তিশালী। আমারও একটু একটু ভয় করে! কিন্তু প্রশ্ন হল, যখন ছাত্রদের মারা হচ্ছে, আদালত চত্বরে সাংবাদিক, অধ্যাপক ও ছাত্রদের বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে, তখন একবারও কেন প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেন না? কেন একবারও রোহিত ভেমুলার পরিবারকে ফোন করলেন না?’’
কংগ্রেস সহ-সভাপতির কথায়, ‘‘আসলে প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তাঁর যা মত, সেটাই শেষ কথা। ঠিক যেমন আরএসএসের নেতারা ভাবেন, তাঁরা যা জানেন সেটাই ঠিক। আর কোনও ভিন্ন মত থাকতে পারে না পৃথিবীতে। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও ব্যাপারটা তাই।’’ উদাহরণ দিয়ে রাহুল বলেন, ‘‘মুম্বই সন্ত্রাসের পর ইউপিএ সরকার কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে পারলেও প্রধানমন্ত্রী স্রেফ খামখেয়ালিপনায় নয়াদিল্লির সেই ছ’বছরের পরিশ্রম পণ্ড করে দিতে পারেন। বলা নেই কওয়া নেই দুম করে নওয়াজ শরিফের বাড়িতে চা খেতে চলে যেতে পারেন। এমনকী, তাঁর সেই পদক্ষেপের কথা বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও হয়তো জানতেন না। একই ভাবে প্রধানমন্ত্রী যখন নাগা-চুক্তি সই করার দাবি করেন, তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানতেও পারেন না যে এমন কোনও সমঝোতা হচ্ছে!’’
রাহুলের পাশাপাশি আজ সকালে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীও সরকারের সমালোচনা করেছেন। সনিয়া এ-ও অভিযোগ করেন যে, মোদী বিরোধীদের সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছেন।
রাহুলের বক্তৃতার পর আজ হই হই করে পাল্টা আঘাত করতে নেমে পড়েন বিজেপি নেতারা। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘‘লোকসভায় থাকলে আমি তখনই জবাব দিতাম। নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে আমার মত চেয়েছিলেন।’’ আবার রাহুলকে টিপ্পনী করে অরুণ জেটলি বলেন, ‘‘আমি যত রাহুলের কথা শুনি, তত অবাক হই! রাহুল কবে আর বড় হবে! আমি মনে করি ভারতের মানুষ ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে প্রধানমন্ত্রী বাইরে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করেন তাঁকে খারিজ করে এমন নেতাকে বেছেছেন যাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।’’ পরে বিজেপি সূত্রে বলা হয়েছে, কাল লোকসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার ধন্যবাদ প্রস্তাবে জবাবি বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। রাহুলের অভিযোগের মোক্ষম জবাব তখন দেবেন তিনি।