আত্মঘাতী সেনার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আটক রাহুল গাঁধী ও অরবিন্দ কেজরীবাল। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
সেনাদের বলিদানের আবেগে সওয়ার হয়ে যখন বাজিমাত করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী, তখন সেনা অস্ত্রেই তাঁকে বধ করতে নামলেন রাহুল গাঁধী ও অরবিন্দ কেজরীবাল।
কম পেনশন আর ‘এক পদ, এক পেনশন’-এ (ওআরওপি) বর্ধিত টাকা না পাওয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার দিল্লিতে আত্মহত্যা করেন এক প্রাক্তন জওয়ান। আর সেই মৃত্যুকে ঘিরে আজ দিনভর নাটক চলল দিল্লির রাস্তায়। মৃত জওয়ানের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দু’-দু’বার আটক হলেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। এমনকী কার্যত নজিরবিহীন ভাবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবাল ও উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়াকেও আটক করে পুলিশ। আটক হন মৃত জওয়ানের ছেলে ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা। রাতে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বিষয়টি ঘিরে উত্তাপ বিন্দুমাত্র কমেনি।
কার আত্মহত্যা ঘিরে এ ভাবে পারদ চড়েছে দিল্লির অলিন্দে? কেনই বা আত্মঘাতী হলেন তিনি?
হরিয়ানার বামলা গ্রামের বাসিন্দা, প্রাক্তন জওয়ান রামকিশন গ্রেবাল (৭০) ৩১ অক্টোবর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকরকে এক চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে, তিনি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ইনফ্র্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নে প্রায় ৭ বছর ও পরে ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর্সে ২৩ বছরেরও বেশি। কিন্তু তাঁর পেনশন যথেষ্ট কম। এবং ‘ওআরওপি’র বর্ধিত টাকাও পান না। এ বিষয়ে বিক্ষোভ দেখাতে গত কাল যন্তর-মন্তরে একটি সমাবেশ ছিল প্রাক্তন জওয়ানদের। মৃত জওয়ানের ছেলে জানিয়েছেন, সেই বিক্ষোভ সমাবেশেই ঠিক হয়, স্মারকলিপি জমা দিতে গ্রেবাল-সহ চার প্রাক্তন জওয়ান যাবেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে। কিন্তু দুপুর দেড়টায় বিদেশ মন্ত্রকের দফতর জওহর ভবনের পিছনের লনে বিষ খান তিনি। বিষ খাওয়ার দু’মিনিটের পরেই ছেলেকে ফোন করেন গ্রেবাল। একটি টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত সেই টেপে শোনা গিয়েছে গ্রেবাল বলছেন, ‘‘সারা জীবন দেশের জন্য কাজ করেছি। দেশের জন্য, দেশের জওয়ানদের জন্য এই আত্মবলিদান।’’ এর কিছু ক্ষণ পরেই মারা যান তিনি।
আজ সেই খবর চাউর হতেই ‘সেনা দখলে’ আসরে নেমে পড়েন রাহুল, অরবিন্দরা। সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে জাতীয়তাবাদের আবেগে ভোট টানতে চাইছেন, সেটি ভোঁতা করতেই আজ রাজধানী দাপিয়ে বেড়ান দুই দলের নেতারা। দুপুর আড়াইটে নাগাদ দিল্লির যে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে মৃতদেহ রাখা ছিল, সেখানে পৌঁছে যান রাহুল। তাঁকে ঢুকতে বাধা দেয় পুলিশ। পরে তাঁকে আটকও করা হয়। আটক করা হয় দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়াকেও। নিয়ে যাওয়া হয় মন্দির মার্গ থানায়। সওয়া ঘণ্টা পরে ছাড়া হয় রাহুলকে। সিসৌদিয়াকে ছাড়া হয় প্রায় দশ ঘণ্টা পরে।
পুলিশের দাবি, হাসপাতাল রাজনীতি করার জায়গা নয়। বিক্ষোভ সমাবেশের হট্টগোলে হাসপাতালের কাজে ব্যাঘাত ঘটছিল। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কয়েক জন নেতাকে আটক করা হয়। বিক্ষোভে সামিল হন রামকিশনের ছেলে যশবন্ত-সহ পরিবারের অনেকে। আটক করা হয় তাঁদেরও। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের ঘুষি মেরেছে, গালিগালাজ করে আটক করেছে।
গত একমাস ধরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। আজ তার পাল্টা জবাব দেওয়ার সুযোগ হারাতে চায়নি আপ বা কংগ্রেস। আটক হওয়ার পরে থানায় বসেই কংগ্রেস নেতারা রাহুলের সঙ্গে পুলিশের কথা কাটাকাটি ভিডিও করেন। রাহুলকে বলেন, ‘‘এ এক নতুন ভারত। পুরোদস্তুর অগণতান্ত্রিক। শহিদের পরিবারকে কী করে গ্রেফতার করা হচ্ছে? তাঁদের গ্রেফতার করা হলে আমাকেও গ্রেফতার করুন।’’ সন্ধে সওয়া ছ’টা নাগাদ মৃতের স্ত্রী-ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ফের আটক হন রাহুল। সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। বেনজির ভাবে হেনস্থা করে পুলিশ তাঁদের প্রথমে নিয়ে যায় সংসদ মার্গ থানায়। কিন্তু কংগ্রেস সমর্থকদের বিক্ষোভের জেরে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় রাহুলদের। নিয়ে যাওয়া হয় তিলক মার্গ থানায়।
ইতিমধ্যে ময়দানে নেমে পড়েন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালও। সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ তিনি টুইট করে জানান, মৃতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন।
রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতাল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতালের কাছে তাঁকেও আটক করা হয়। আটকের সময় কেজরীবাল বলেন, ‘‘এতদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী বলে আসছিলেন ওআরওপি চালু হয়ে গিয়েছে। তার মানে তিনি দেশবাসীকে মিথ্যা বলে ছলনা করছিলেন।’’ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আর কে পুরম থানায়। আপ সমর্থকদের বিক্ষোভে তেতে ওঠে এলাকা। রাতের খবর, পৌনে ন’টা নাগাদ ছেড়ে দেওয়া হয় কেজরীবালকে। কিন্তু থানা ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন তিনি।
মোদী সরকারের বিরোধিতায় এ দিন সরব হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এক টুইট বার্তায় তৃণমূলনেত্রী বলেন,‘‘হচ্ছেটা কী? মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর নিজের রাজ্যেই আটক করা হচ্ছে? এটা চলতে পারে না!’’ মৃতের পরিবারের সঙ্গে রাহুলকে দেখা করতে না দেওয়ারও সমালোচনা করেন মমতা। বলেন, ‘‘এটা দুর্ভাগ্যজনক।’’ অন্না হজারেও রাতে এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, ওআরওপি যথাযথ ভাবে চালু না হলে ফের বিক্ষোভ শুরু করবেন তিনি।
রাত সওয়া আটটায় তিলক মার্গ থানায় পৌঁছন দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত, কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেল এবং কংগ্রেসের আইনজীবীরা। তার মিনিট পনেরো পরে ছেড়ে দেওয়া হয় রাহুল ও অন্যান্য নেতা-কর্মীকে। থানার সামনেই সাংবাদিক বৈঠক করেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি। প্রশ্ন তোলেন, ‘‘মৃতের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম, তাঁদের সমর্থন জানাতে গিয়েছিলাম। এটাই কি আমার অপরাধ?’’ রামকিশনের ছেলেকে আটক করা প্রসঙ্গে রাহুলের দিল্লি পুলিশকে (যে দিল্লি পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে) প্রশ্ন ‘‘আপনাদের কি কোনও লজ্জা নেই?’’ আগামিকাল সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে তিনি বামলা গ্রামে পৌঁছে যাবেন বলে জানিয়েছেন রাহুল। গ্রামেই রামকিশনের অন্ত্যেষ্টি হবে। কেজরীবালও জানিয়েছেন, তিনি অন্ত্যেষ্টিতে থাকতে চান।
যে সেনার জয়গান করে তিনি ভোট-যুদ্ধে ফায়দা তুলতে চেষ্টা করছেন, তাতে আঁচ পড়তে দেখে গোটা বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সকালেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে মোদী বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। পর্রীকর জানান, ‘‘এই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু নিয়ে আমি রিপোর্ট চেয়েছি।’’ প্রাথমিক ভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আত্মঘাতী জওয়ান ১১,৩০০ টাকার মতো মূল পেনশন, তার উপর ১২৫ শতাংশ মহার্ঘভাতার সুবিধা পাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর ২৮ লক্ষ টাকার দেনা ছিল। সেটাও তাঁর আর্থিক দূরাবস্থার অন্যতম কারণ বলে দাবি করা হয়েছে। পরে মন্ত্রক থেকে জানানো হয়,গ্রামের যে ব্যাঙ্কে জওয়ানের পেনশনের অ্যাকাউন্ট ছিল, সেখানে হিসেবের কিছু গণ্ডগোল হয় ফলে তাঁর প্রাপ্য ২৮ হাজার টাকা পেনশনের থেকে দু’তিন হাজার টাকা কম পাচ্ছিলেন তিনি। তা ছাড়া, তিনি ওআরওপির সুবিধাও পাচ্ছিলেন বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
এর মধ্যে আবার বেঁফাস মন্তব্য করে বসেন প্রাক্তন সেনাপ্রধান ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি কে সিংহ। আত্মঘাতী প্রাক্তন জওয়ানের মানসিক অবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, ‘‘তাঁর মানসিক অবস্থা কী ছিল, সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার।’’ ভি কে সিংহের এই মন্তব্যে আরও তেড়েফুঁড়ে ওঠে বিরোধীরা। কংগ্রেস মুখপাত্র আনন্দ শর্মা দাবি করেন, ২০১৪-র অন্তর্বতিকালীন বাজেটেই ওআরওপি-র প্রস্তাব এনে তার জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল ইউপিএ সরকার। মোদী ক্ষমতায় এসে সেই পথেই চলেছেন এবং এখন তার ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন।
বিজেপির পাল্টা দাবি, ৪০ বছর ধরে ওআরওপি চালু হয়নি। কেউ তো এত দিন আত্মহত্যা করেননি। অমিত শাহ-ঘনিষ্ঠ বিজেপির সচিব শ্রীকান্ত শর্মা বলেন, ‘‘রাহুল অপেক্ষা করেন, কার কখন মৃত্যু হবে, যাতে তিনি রাজনীতি করতে পারেন। তিনি একজন পার্ট টাইম রাজনীতিক।’’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রেবালকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে— এমন দাবি করছে বিজেপির একটি সূত্র। বিক্ষোভ দেখাতে এসে কী ভাবে আত্মহত্যা করার জন্য বিষ পেলেন গ্রেবাল, সেই প্রশ্নও উঠছে।
টানাপড়েনের এই আবহে মোদীর কৃতিত্বের ফানুস ফুটো করার কোনও সুযোগই হারাতে রাজি নয় কংগ্রেস ও আপ। উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে আপাতত সে-টুকুই প্রাপ্তি তাদের।
• মঙ্গলবার দুপুর ১-৩০: জওহর ভবন চত্বরে বিষ খেলেন প্রাক্তন জওয়ান রামকিশন গ্রেবাল।
• দুপুর ১-৩২: ছেলেকে রামকিশনের ফোন— ‘‘জওয়ানদের জন্য এই আত্মবলিদান।’’
• বুধবার সকাল: রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে রামকিশনের দেহ। কংগ্রেস ও আপের বিক্ষোভ।
• দুপুর আড়াইটে: হাসপাতালে রাহুল গাঁধী। ঢুকতে বাধা পেলেন। পরে আটক। আটক দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া এবং রামকিশনের ছেলেও।
• বিকেল পৌনে চারটে: ছাড়া হল রাহুলকে। ফের হাজির হাসপাতালের সামনে।
• সন্ধে সওয়া ছ’টা: আবার আটক করল পুলিশ।
• সন্ধে সাড়ে ছ’টা: রামকিশনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাস্তাতেই আটক অরবিন্দ কেজরীবাল।
• রাত সাড়ে আটটা: ছেড়ে দেওয়া হল রাহুল ও মণীশ সিসৌদিয়াকে।
• পৌনে ন’টা: ছেড়ে দেওয়া হল কেজরীবালকে। থানা ছেড়ে যেতে অস্বীকার।