প্রায় একই কথা বলেছিল ইউপিএ জমানার জে এম লিংডো কমিটি। এ বার এনডিএ জমানার কমিটিও শিক্ষার উঠোন থেকে ছাত্র রাজনীতি বিদেয় করার পক্ষেই সওয়াল করল।
এটাকেই দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হাঙ্গামা, অনিয়মিত ক্লাস, দেরিতে পরীক্ষা হওয়ার মতো রোগ থেকে মুক্ত করার দাওয়াই বলে মনে করছে টিএসআর সুব্রহ্মণ্যম কমিটি। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে পেশ হওয়া রিপোর্টটি গত কাল ফাঁস হয়ে গিয়েছে। তাতেই ছাত্র-রাজনীতি বন্ধের এই সুপারিশের কথা জানার পরে দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এক সুরে সরব হয়ে উঠেছে এর বিরুদ্ধে। এমনকী, বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-ও। এদের অভিযোগ, শিক্ষার বেসরকারিকরণ রুখতে ছাত্র সংগঠনগুলি যাতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে না পারে, সেই জন্যই তাদের আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে শাসক শিবির।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এ ছাত্র-আন্দোলন ও সরকারের দমন নীতি নিয়ে গোটা দেশে বিতর্কের ঝড় ওঠার পরপরই সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু মন্তব্য করেছিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। সুব্রহ্মণ্যম কমিটির সুপারিশ নতুন করে সেই বিতর্ককে উস্কে দিল।
দক্ষিণে হায়দরবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্বে যাদবপুর ও উত্তরে জেএনইউ—
দেশের তিন প্রান্তের তিন নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে বারবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে ছাত্র রাজনীতির কারণেই। স্বাভাবিক ভাবেই এতে পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। পিছিয়ে দিতে হয়েছে পরীক্ষাও। এই ধরনের নেতিবাচক রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করে সুব্রহ্মণ্যম তাঁর রিপোর্টে প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আদৌ কি ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্ম ও জাতপাতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও দলকে ভেঙে দেওয়ারও সুপারিশ করেছেন তিনি।
ছাত্র রাজনীতির বাড়াবাড়ি নিয়ে কমিটির পর্যবেক্ষণ: যখন-তখন রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রায়ই অবাঞ্ছিত পরিবেশ তৈরি হয়। ধর্না-বিক্ষোভ, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি আখেরে ক্যাম্পাসেরই পরিবেশ খারাপ করে। লাগাতার ছাত্র-বিক্ষোভের কারণে ভেস্তে যায় রুটিন পড়াশোনা। অথচ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, ওই বিক্ষোভ বা ধর্নার পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক মদত পাওয়া অল্প কয়েক জন ছাত্র। যারা নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য বাকি পড়ুয়াদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর থাকে। শিক্ষা গ্রহণ নয়, হাতে গোনা ওই ছাত্রদের লক্ষ্যই হল রাজনীতি করা। আর তাই পরীক্ষা না দিয়ে এরা বছরের পর বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকে।
এই ক্ষেত্রে কমিটির অভিযোগের আঙুল উঠেছে মূলত পিএইচডি বা গবেষণাধর্মী পাঠ্যক্রমে ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের দিকেই। যারা গবেষণার নামে বছরের পর বছর হোস্টেলে থেকে যায়। প্রসঙ্গত, জেএনইউয়ের কানহাইয়া কুমার বা হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোহিত ভেমুলা—ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দুই নেতাই পিএইচডির ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কমিটির মতে, এই ছাত্ররা ফেলোশিপ থেকে পাওয়া অর্থের দাক্ষিণ্যে দিনের পর দিন হোস্টেলে থেকে সেখানকার পরিবেশকে নষ্ট করে এবং অন্য ছাত্রদের রাজনীতিতে নামার জন্য উৎসাহিত করে। কমিটির তাই মন্তব্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনীতির আখড়া নয় যে রাজনৈতিক দলগুলি সেখানে নিজেদের রেষারেষি মেটাবে। জনগণের করের টাকা এ ভাবে বছরের পর বছর ছাত্র-ছাত্রীরা নষ্ট করতে পারে কি না, তা নিয়ে জাতীয় স্তরে বিতর্ক হওয়া দরকার বলে মনে করেন প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব সুব্রহ্মণ্যম। প্রয়োজনে এক জন ছাত্র সর্বাধিক কত বছর প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে থাকতে পারে, সে বিষয়ে মন্ত্রকের একটি স্পষ্ট নির্দেশ থাকা উচিত।
কমিটির মতে, ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই মুখ খোলার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই অধিকার যেন অন্য পড়ুয়াদের সমস্যায় না ফেলে। দশ বছর আগে গঠিত লিংডো কমিটিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতি থেকে মুক্ত করার পক্ষে সওয়াল করেছিল। পরে সুপ্রিম কোর্টও স্বীকার করে নেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পড়াশুনোর পরিবেশ তৈরিতে ছাত্র ইউনিয়নগুলির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
এই যুক্তি মানতে রাজি নয় ছাত্র সংগঠনগুলি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে পারে, তাই এই সুপারিশ করা হয়েছে বলে মনে করছেন ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। এটা আসলে মুখ খোলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার নামান্তর বলেই মনে করছেন জেএনইউ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি শীলা রশিদ। তাঁর কথায়, ‘‘পরোক্ষে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে চাইছে সরকার।’’
এবিভিপি-ও সরব হয়ে উঠেছে সুব্রহ্মন্যম কমিটির এই সুপারিশের বিরুদ্ধে। এসএফআইয়ের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন, ‘‘এই নীতি কার্যকর হলে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হবে। আগামী দিনে গরিব ও দুঃস্থ পড়ুয়াদের জন্যও ইউনিয়ন মুখ খুলতে পারবে না। আসলে শিক্ষার বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যেই ধীরে ধীরে ইউনিয়নগুলির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।’’