ভুল! বিলকুল ভুল করেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পামুলাপর্তি বেঙ্কট নরসিংহ রাও। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার মতো ঘটনা হয়তো রুখে দেওয়া যেত। কিন্তু, মূলত, নরসিংহ রাওয়ের ব্যর্থতাতেই তা হয়নি।
বাবরি ধ্বংসের ২৪ বছর পর সরাসরি এই সমালোচনাটা যাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এল, তাঁর নাম রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড, ‘দ্য টারবুল্যান্ট ইয়ার্স— ১৯৮০-৯৬’-এ রাষ্ট্রপতি লিখেছেন, ‘‘ওই ঘটনা আমাদের প্রত্যেকটি ভারতীয়ের মাথা নুইয়ে দিয়েছে। আমরা গোটা বিশ্বের কাছে খুব ছোট হয়ে্ গিয়েছি। পি ভি নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে যে ক’টি ভুল করেছিলেন, বাবরি ধ্বংসের ঘটনা রুখতে না পারাটা তার অন্যতম। ওটাই ছিল পি ভির সবচেয়ে বড় ভুল। ওই ঘটনা রুখতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর জন্য ওই সময় কোনও বিচক্ষণ রাজনীতিকের ওপর ভরসা রাখা উচিত ছিল পি ভি-র। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিটা যিনি হাতের তালুর মতো জানেন, চেনেন।’’
বরাবরই মেপে পা ফেলা বিচক্ষণ রাজনীতিক প্রণববাবু কখনওই কোথাও বলেননি বা লেখেননি যে, সেই দায়িত্বটা তাঁকে দেওয়ার মতো ভরসা বা আস্থার কোনওটাই দশ জনপথ-ঘনিষ্ঠ প্রণববাবুর ওপর রাখতে পারেননি পামুলাপর্তি বেঙ্কট নরসিংহ রাও। তবে শোনা যায়, বাবরি ধ্বংসের ঘটনার পর প্রণববাবু একেবারেই একান্তে নরসিংহ রাওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘এটা কতটা বিপজ্জনক ঘটনা, তা বোঝানোর মতো কোনও পরামর্শদাতা কি আপনার ধারে-কাছে ছিল না? আপনি কি নিজেও বুঝতে পারেননি, গোটা বিশ্বে ওই ঘটনার কী প্রভাব পড়তে পারে? এখন অন্তত সদর্থক এমন কিছু পদক্ষেপ করা হোক, যাতে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতায় লাগাম পরানো যায়। বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের ভাবাবেগকে মর্যাদা দেওয়া যায়।’’
আর এই ভাবেই প্রণববাবু বুঝিয়ে দিলেন, বিষয়টা যদি হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, তা হলে তাঁর পরিচিত রক্ষণাত্মক ভঙ্গি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে মোটেই পিছপা হন না তিনি।
তাঁর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে দীর্ঘ দিনের আরও একটি রহস্যেরও উন্মোচন করেছেন রাষ্ট্রপতি। ভারতীয় রাজনীতিতে গুঞ্জনটা ছিল দীর্ঘ দিনের। ইন্দিরা গাঁধীর হত্যাকাণ্ডের পর নাকি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন তিনি। ইন্দিরার সর্বশেষ মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সেই সদস্যই আজ ভারতের রাষ্ট্রপতি। তিনিই ছিলেন গুজবটার কেন্দ্রবিন্দু। যা এ বার নস্যাৎ করে দিলেন তিনি— প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেই।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড, ‘দ্য টারবুল্যান্ট ইয়ার্স— ১৯৮০-৯৬’। প্রণববাবু সেখানে স্পষ্ট বলেছেন, ‘সেই সময়ে গুজব ছড়িয়েছিল, আমি নাকি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই। সে জন্য যথাসম্ভব চেষ্টাও নাকি করছি! এর ফলে রাজীব গাঁধীর মনে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। অথচ এই গল্পগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
ঠিক কী হয়েছিল সেই সময়ে?
পাঠকদের সামনে সেই নেপথ্য-কাহিনিই হাজির করেছেন প্রণববাবু। লিখেছেন একটা বিশেষ দিনের কথা— ‘সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাকে ওঁর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। সনিয়া আর রাজীব একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখে আমি পিছন থেকে রাজীবের কাঁধে টোকা দিই। রাজীব সনিয়ার হাত ছাড়িয়ে আমার দিকে ফেরেন। উনি বোঝেন যে, অত্যন্ত গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু না থাকলে আমি বিরক্ত করতাম না। ঘরের পাশেই বাথরুমে উনি আমাকে টেনে নিয়ে যান, যাতে ঘরের কেউ আমাদের কথা শুনতে না পায়।’
এর পর বাথরুমেই প্রণববাবু রাজীবকে জানিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা ইন্দিরা-পুত্রকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন। রাজীব সম্মত হলে বাইরে বেরিয়ে এসে রাজীবের সিদ্ধান্ত সে দিন সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রণববাবুই!
আজ রাষ্ট্রপতি ভবনে বইটির উদ্বোধন করেন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দলের নেতারা। ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, কর্ণ সিংহ, নটবর সিংহরা। আজ নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় আরও একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গিয়েছেন প্রণববাবু। সেটি হল, ১৯৮৪ সালে তাঁর কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার এবং নতুন দল গড়া। সেই প্রসঙ্গে প্রণববাবু বলেছেন, ‘‘আমার নিজের দল গড়ার কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। আমি কখনওই জননেতা ছিলাম না। অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে দল গড়েছেন। যেমন অজয় মুখোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বয়ং ইন্দিরা গাঁধী। আমি জননেতা হিসেবে এঁদের কাছাকাছিও নই।’’
বইয়ের নামেই ইঙ্গিত, দেশের ইতিহাসে উথালপাতাল অনেকগুলো বছরের ইতিবৃত্ত তাঁর কলমে তুলে ধরেছেন ভারতীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনগুলো ফিরে দেখতে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের কড়া সমালোচনা করেছেন প্রণববাবু। বলেছেন, ‘ওই ঘটনায় প্রতিটি ভারতীয়র মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনা রুখতে না পারা পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।’’ এ ছাড়া প্রণববাবুর কলমে উঠে এসেছে অসম এবং পঞ্জাবের সমস্যা, অপারেশন ব্লু স্টার, রাজীবের সঙ্গে তাঁর বহুচর্চিত সম্পর্ক এবং তিন-তিনটি আকস্মিক মৃত্যু— সঞ্জয়, ইন্দিরা এবং রাজীবের।
প্রণববাবু বলেছেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বহু গোপন তথ্যের সাক্ষী থেকেছেন ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছে করেই সে সব কথা লেখেননি। তাঁর কথায়, ‘‘চার্চিলের মতো অনেক নেতাই রয়েছেন, যাঁরা এই মন্ত্রগুপ্তিতে বিশ্বাস করেননি। তাঁদের প্রতি আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি মন্ত্রী হওয়ার সময় মন্ত্রগুপ্তির যে শপথ নিয়েছিলাম, তা গোটা জীবন অক্ষুণ্ণ রাখব। সরকার যদি কখনও মনে করে কোনও তথ্য প্রকাশ্যে আনবে, তা হলে সেটা সরকার করবে।’’