পূর্ণিমা কোঠারী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাত ৮টা ৫০। কলকাতায় রাত ধরা হয় না, সন্ধেই বরং। উৎসবের আবেশে চনমন করতে থাকা অযোধ্যাতেও ৮টা ৫০ মোটেই রাত নয়। বরং গমগম করছে করসেবকপুরমের ঢিলছোড়া দূরত্বে টুরিস্ট স্পটের হোটেল সুলভ সৌষ্ঠবে দাড়িয়ে থাকা মানস ভবন। তবু তর্জনী তুললেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যকর্তা, ‘‘নহি, পহলে ভোজন কর লেনে দিজিয়ে, উসসে পহলে কুছ ভি নহি।’’
নিজের ‘ভোজন’-এর কথা কিন্তু বলছেন না ওই গেরুয়া উত্তরীয়ধারী। বলছেন পূর্ণিমা কোঠারীর নৈশাহারের কথা। কলকাতা থেকে অযোধ্যায় পৌঁছনো ইস্তক একের পর এক কর্মসূচি, বৈঠক, সংবর্ধনা। বিশ্রাম একেবারেই হয়নি পূর্ণিমার। সুতরাং হোক না পূর্ণিমার নিজের শহর থেকে অযোধ্যায় আসা সংবাদমাধ্যম, নৈশাহার না হওয়া পর্যন্ত আর কোনও কথা বলার অনুরোধ করা যাবে না। মৃদু কঠোর স্বর, বিস্ফারিত চক্ষু এবং উদ্যত তর্জনীর বার্তা এই।
৩০ বছর আগের কথা। ১৯৯০ সাল। লালকৃষ্ণ আডবাণী সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রথযাত্রা শুরু করেছেন, কিন্তু তা শেষ হয়নি। আডবাণীর রথ বিহারে ঢুকতেই তার গতিরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব, আডবাণীকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার থেমে থাকেনি। অযোধ্যায় করসেবার আহ্বান জানানো হয়েছে। হাজার হাজার হাজার করসেবক রামনগরীতে জড়ো হয়ে তাণ্ডব শুরু করেছেন।
সেই ছিল প্রথম করসেবা। আর ভারতের রাজনীতির ইতিহাসের সেই অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণ বদলে দিয়েছিল পূর্ণিমা কোঠারীর পরিবারের আকার। বজরঙ্গ দলের কর্মী পূর্ণিমার দুই দাদা করসেবায় যোগ দিতে কলকাতা থেকে অযোধ্যা পৌঁছেছিলেন। দেশের আরও নানা প্রান্ত থেকে আরও হাজার হাজার করসেবকের মতো। বাবরি মসজিদের কাঠামোর মাথায় প্রথম বার গেরুয়া পতাকা ওড়ানো হয়েছিল ১৯৯০-এর ৩০ অক্টোবর। তার পরে মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের নির্দেশে প্রবল পুলিশি পদক্ষেপ, করসেবকদের সঙ্গে সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা। সেই মৃতের তালিকায় কলকাতার রামকুমার কোঠারী, শরদকুমার কোঠারী।
আরও পড়ুন: উৎসবে উদ্বেল অযোধ্যা, গভীরে খেলছে দ্বিধার চোরাস্রোত
রামকুমার কোঠারী, শরদকুমার কোঠারীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা। নিজস্ব চিত্র।
দুই ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ যখন অযোধ্যা থেকে কলকাতার বাড়িতে পৌঁছেছিল, একমাত্র বোন পূর্ণিমা তখন ১৯। দুই তাজা জোয়ান ছেলের মৃত্যুসংবাদে বাবা-মা শোকে বিহ্বল। পূর্ণিমা নিজে দিশাহারা। ওই দিনের প্রসঙ্গ উঠলে তাই চোখমুখের অভিব্যক্তি আজও বদলে যায়। অত্যন্ত শান্ত অথচ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতেও চোখে শূন্যতা ফুটে ওঠে মুহূর্তের জন্য। কথা আটকে যায়। তার পরে বলেন, ‘‘দুই দাদার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমাদের পরিবারের অবস্থা তো শোচনীয় ছিলই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয় পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার।’’
কেন ভয় পেয়েছিল? পূর্ণিমার মতে, করসেবকদের আক্রোশ বাংলাতেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে পারে বলে জ্যোতি বসুর সরকারের মনে হয়েছিল। তাই বাড়িতে বার বার পুলিশ আসছিল। রাম আর শরদের শেষকৃত্য কোথায় হবে জানতে চাওয়া হচ্ছিল। দেহ কলকাতায় না ফেরানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। মুলায়মের পুলিশের গুলিতে মৃত রামকুমার কোঠারী, শরদকুমার কোঠারীর দেহ শেষ পর্যন্ত জ্যোতি বসুর কলকাতায় ফেরেনি। সেটা পুলিশের পরামর্শ বা চাপের কারণে নয়। ‘‘অযোধ্যার মতো পূণ্যভূমিতে যখন মূত্যু হয়েছে, তখন শেষকৃত্য অযোধ্যাতেই হোক। জানিয়ে দিয়েছিলেন বাবা।’’ বলেন পূর্ণিমা। তবে তার পর থেকে কী ভাবে বিজেপি সমর্থক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল গোটা পরিবারকে, অযোধ্যায় বসে সে স্মৃতিও রোমন্থন করেন রাম-শরদের একমাত্র বোন।
আরও পড়ুন: ভূমিপূজার প্রস্তুতি শেষ, প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষায় অযোধ্যা
করসেবার জন্য প্রাণ ‘বলিদান’ দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের পরিজনদের সাদরে অযোধ্যায় ডেকেছে শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট। ভূমিপূজন এবং শিলান্যাস যখন করবেন প্রধানমন্ত্রী, তখন এঁরাও উপস্থিত থাকবেন রামজন্মভূমির অন্দরে। অর্থাৎ এঁরা ওই ২০০ আমন্ত্রিতের তালিকার মধ্যে রয়েছেন, যে তালিকায় ঠাঁই পাননি খোদ লালকৃষ্ণ আডবাণী বা মুরলীমনোহর জোশীও। সে কথা ভেবে কি আবেগের বিস্ফোরণ ঘটছে পূর্ণিমা কোঠারীর মধ্যে? পঞ্চাশের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া পূর্ণিমা আবেগ প্রকাশের ব্যাপারে বেশ সংযত। তাই কোনও বিস্ফোরণ নেই। তবে জীবন একটা পূর্ণবৃত্তের আকার নিল বলে তিনি মনে করছেন।
রাতের খাওয়া দ্রুত সেরে নিয়েই কথা বলতে বসেছিলেন পূর্ণিমা। অজস্র গাড়ির ভিড়, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শ’য়ে শ’য়ে কার্যকর্তার আনাগোনা, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ভিভিআইপি চেহারা নিয়েছে মানস ভবন। রামমন্দিরের কার্যশালার ঠিক পাশেই অবস্থান তার। সে ইমারতের নীচের তলায় লম্বা লাউঞ্জে বসে পূর্ণিমা কোঠারী বললেন, ‘‘২৮ জুলাই আমন্ত্রণ পেলাম। চম্পত রায়জি (ট্রাস্টের মহাসচিব) নিজে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন এই অনুষ্ঠানে আমাকে আসতে হবে। যে মুহূর্তে আমন্ত্রণটা পেলাম, মনে হল আমার দুই দাদার বলিদান সার্থক। যে কাজের জন্য এত বড় বলিদান, সেই কাজ অবশেষে হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: ‘রাম সবার’, শেষবেলায় টুইট প্রিয়ঙ্কার, অযোধ্যা নিয়ে পালে হাওয়া টানতে মরিয়া কংগ্রেস
বুধবার ভূমিপূজন। মঙ্গলবার অযোধ্যা পৌঁছেছেন পূর্ণিমা কোঠারী। কিন্তু দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বিন্দুমাত্র বসার সময় পাননি। জানালেন অনুযোগের সুরে। প্রাণ গিয়েছিল যে করসেবকদের, তাঁদের পরিজনদের ঠিক কতটা সম্মান দেখাতে চাইছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, তার আভাস এই সাক্ষাৎ পর্বের শুরুতেই মিলেছিল গেরুয়া উত্তরীয়ধারীর মেজাজে। পরে পূর্ণিমা কোঠারী কথাতেও মিলল সেই সম্মান প্রদর্শনের খবর। ‘‘এক ঘণ্টা ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে তো আমাদের ঘিরে ভাষণ চলল প্রথমে। আমি তার পরে বললাম, এতটা রাস্তা এসেছি, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছি, পায়ে ব্যথা করছে। আমি বসছি। সবাই তাড়াতাড়ি বসার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানটা অনেকক্ষণই চলল,’’— বললেন পূর্ণিমা। সে সব শেষ হতেই শুরু হল ভার্চুয়াল বৈঠক। কোঠারী পরিবার আগে থেকেই সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। পরিবারের দুই সদস্যের মৃত্যুর পরে সে যোগাযোগ আরও নিবিড় হয়। সঙ্ঘের নানা কাজে সক্রিয় ভাবে অংশ নিতে শুরু করেন পূর্ণিমা নিজে এবং তাঁর বাবা-মা। এ দিনের ভার্চুয়াল বৈঠকও সাংগঠনিকই ছিল। অযোধ্যায় গিয়েও সে কাজকে অবহেলা করেননি রাম-শরদের বোন। শত ব্যস্ততার মাঝেও বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। আর রাতেই স্থানীয় প্রশাসন এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরঙ্গ দলের পদাধিকারীদের সঙ্গে দেখা করে নেওয়ার কর্মসূচিও তৈরি রেখেছেন।
৩০ বছর আগে দুই দাদার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে তরুণী, আজকের পূর্ণিমা আর সেই পূর্ণিমা নন। এই পূর্ণিমা কথাবার্তায় ধীরস্থির, পরিণত, সংযত। এই অযোধ্যার মাটিতেই তো শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিবারের দুই তরতাজা যুবক— বার বার সম্ভবত আজ মনে হচ্ছে পূর্ণিমার। মন ভারাক্রান্তও হচ্ছে। কিন্তু সামলেও রাখছেন নিজেকে। রাম কোঠারী, শরদ কোঠারীর ‘বলিদান’ বৃথা যায়নি, মনে করছেন তিনি। আবেগ বশে রাখার মন্ত্র হয়তো সেটাই। জীবন যে স্পষ্ট ভাবে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া দেখিয়ে দিল, তা-ও বুঝছেন পূর্ণিমা। স্বজন বিয়োগের তীব্র যন্ত্রণায় প্রলেপ দিচ্ছে ভূমিপূজনের অযোধ্যা।