নরেন্দ্র মোদী সরকার যুক্তি দিয়েছিল, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে আদালত নাক গলাতে পারে না। সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট জানিয়ে দিল, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও আদালত খতিয়ে দেখতে পারে। সেটাই সংবিধানের সার কথা।
মোদী সরকারের দাবি ছিল, উত্তরাখণ্ডে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি নিজেই সম্মতি জানিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আর বিচার চলে না। এটা একেবারেই ভুল কথা বলে জানিয়ে দিলেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কে এম জোসেফ এবং বিচারপতি ভি কে বিস্ত। বুঝিয়ে দিলেন, রাজার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কিন্তু সংবিধানে বাঁধা এই দেশে কারও সিদ্ধান্তই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। বিচারপতিদের কথায়, ‘‘রাজ-সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই। বিচার বিভাগ যে কোনও কিছুই পর্যালোচনা করতে পারে। রাষ্ট্রপতিও ভীষণ ভাবে ভুল করতে পারেন।’’
দিন কয়েক আগেই বিচার বিভাগের অতিসক্রিয়তা নিয়ে সতর্ক করেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। বলেছেন, ‘‘বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইনসভার মধ্যে কাজের বিভাজন সংবিধানেই করা হয়েছে। সেই ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ঠিক নয়।’’ ঘটনাচক্রে, রাষ্ট্রপতিরই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের বিচারপতিরা আজ মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘মানুষের ভুল হয়, তিনি রাষ্ট্রপতিই হোন বা বিচারপতি।’’
উত্তরাখণ্ডে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন বরখাস্ত মুখ্যমন্ত্রী হরীশ রাওয়ত। অভিযোগ, রাজ্যে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই রাষ্ট্রপতি শাসনকে কাজে লাগানো হয়েছে। যার সূত্রে দেশের আইন জগতের সেরা সেরা মস্তিষ্করা এখন নৈনিতালে। কেন্দ্রের তরফে অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি, রাজ্যপাল কে কে পলের হয়ে হরিশ সালভে এবং কংগ্রেসের তরফে অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি।
কেন্দ্রের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারির করার সিদ্ধান্তে নিজের ‘রাজনৈতিক প্রজ্ঞা’র ভিত্তিতে সম্মতি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। স্পিকার কংগ্রেসের ন’জন বিক্ষুব্ধ বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়ার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিচারপতিরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির ‘প্রজ্ঞা’ নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন না। কিন্তু সব কিছুই আইনি পর্যালোচনার অধীন। এবং ৯ জন বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়ার জন্যই রাষ্ট্রপতি ৩৫৬ ধারা জারিতে সম্মত হয়েছেন, কেন্দ্রের দিক থেকে তা ধরে নেওয়াও অযৌক্তিক।
আদালতে রাষ্ট্রপতি শাসনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে রোহতগি বিগত রাওয়ত সরকারের দুর্নীতির কথাও তুলেছিলেন। বিচারপতিরা তাতে মন্তব্য করেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি যদি দুর্নীতির জন্য ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন, তা হলে দেশের কোনও রাজ্য সরকারই পাঁচ মিনিটের বেশি টিকবে না।’’
বস্তুত, প্রথম
থেকেই রাষ্ট্রপতি শাসন নিয়ে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টে কড়া প্রশ্নের মুখে পড়ছে কেন্দ্র। ‘নির্বাচিত সরকার’-এর ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ‘বিশৃঙ্খলা’ তৈরির জন্য কেন্দ্রের সমালোচনা করে হাইকোর্ট এই প্রশ্নও তুলেছে, কেন্দ্র কি আতসকাঁচ হাতে নিয়ে কোথায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যায়, সেই সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে? স্পিকার বিধায়কদের সদস্যপদ খারিজ করে দিচ্ছেন, তা কেন্দ্রের কেন মাথাব্যথার কারণ হবে? কেন্দ্র এ ক্ষেত্রে কোনও রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পারে না। রাজ্যের সরকার কংগ্রেস না বিজেপির, তা-ও তাদের দেখার বিষয় নয়। কেন্দ্রের উদ্দেশে বিচারপতিরা বলেছেন, ‘আপনারা গণতন্ত্রের শিকড়ে আঘাত করছেন। এই ভাবে খেয়ালখুশি মতো রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হলে ভবিষ্যতের জন্য
ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। ১০-১৫ বছর পরে এর প্রভাব কী পড়বে, সেটাও ভাবা দরকার।’’
কংগ্রেসের ন’জন বিক্ষুব্ধ বিধায়ক হরীশ রাওয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করায় উত্তরাখণ্ডে সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে বলে দাবি তুলেছিল বিজেপি। আনা হয় অনাস্থা প্রস্তাব। কিন্তু আস্থাভোটের আগেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়ে যায়। স্টিং-ভিডিও দেখিয়ে দাবি করা হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত রাওয়ত বিধায়কদের টাকা দিয়ে কিনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে চাইছেন। আদালতে রাজ্যপালের কৌঁসুলি হরিশ সালভে যুক্তি দেন, যদি কেন্দ্রের কাছে বিধায়ক কেনাবেচার যথেষ্ট প্রমাণ থাকে, তা হলে কি আস্থাভোট হতে দেওয়া উচিত? সেক্ষেত্রে তো নীরব দর্শক হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও বেআইনি সরকারকেই ক্ষমতায় থাকায় সুযোগ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের তরফে রোহতগি বলেন, ‘‘এক বার সরকার ভোটাভুটিতে অর্থবিল পাশ করাতে পারেনি। তার পরেও তাকে ফের আস্থাভোটের দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার দরকার নেই। রাষ্ট্রপতির কাছে একটি ঘটনাই যথেষ্ট। তিনি অপেক্ষা করতে বাধ্য নন।’’ কিন্তু বিচারপতিদের বক্তব্য, ন’জন বিধায়ক বিদ্রোহ করায় দলত্যাগ-বিরোধী আইনে তার ফল পেতে তাঁরা বাধ্য। সে ক্ষেত্রে বিধানসভায় সমীকরণও বদলাতই। কিন্তু ভোটাভুটি না হতেই কেন্দ্র কী ভাবে জেনে ফেলল ৩৫ জন বিধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতেন! এ ক্ষেত্রে আগেভাগে নাক গলানো উচিত হয়নি কেন্দ্রের।
আগামী কালও এই মামলার শুনানি চলবে। কিন্তু বিচারপতিদের কড়া মনোভাব দেখে এ দিনই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসে পড়েন। উত্তরাখণ্ডের ভারপ্রাপ্ত নেতা শ্যাম জাজু ও কৈলাস বিজয়বর্গীয়র মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়। কৈলাস দাবি করেন, ‘‘কালও আমাদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। আজকেও রয়েছে। সুযোগ মিললেই আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেব।’’