বফর্স দুর্নীতির অভিযোগে একদা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল রাজীব গাঁধীর সরকার। গাঁধী পরিবারের বিরুদ্ধে সেই কলঙ্কের কালি আজও সুযোগ পেলেই ছেটানোর চেষ্টা করে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস-বিরোধী শক্তিগুলি। কিন্তু সেই অভিযোগ যে প্রমাণিত সত্য নয়, দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থেকে তা জানাতে চাইলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
এ সপ্তাহের শেষে সুইডেন সফরে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। তার আগে একটি সুইডিশ সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন রাষ্ট্রপতি। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি মনে করেন যে বফর্স কাণ্ডে সংবাদমাধ্যমই বিচারকের ভূমিকা নিয়েছিল? জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘প্রথম কথা হল, এখনও প্রমাণ হয়নি যে দুর্নীতি হয়েছিল। কোনও ভারতীয় আদালতে তা প্রমাণিত হয়নি। বফর্স পর্বের বহু বছর পরে যখন আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলাম, আমায় সব সেনাপ্রধান বলতেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সব চেয়ে সেরা কামান এটি। এখনও ভারতীয় সেনাবাহিনী ওই কামান ব্যবহার করে।’’ প্রণববাবুর কথায়, ‘‘তথাকথিত যে কেলেঙ্কারির কথা বলা হয়, তা কেবল সংবাদমাধ্যমই প্রচার করেছে, তারাই কাটাছেঁড়া করেছে। কিন্তু সেই প্রচারে ভেসে না যাওয়াই ভাল।’’ রাষ্ট্রপতিকে এও প্রশ্ন করা হয়, তা হলে কি সংবাদমাধ্যমই এই কেলেঙ্কারির তত্ত্ব প্রচার করে? জবাবে প্রণববাবু বলেন, ‘‘আমি সে কথা বলছি না। সংবাদমাধ্যমে এই বিষয়ে লেখালেখি হয়েছিল। কিন্তু আদালত এই কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে কোনও নির্ণায়ক রায় দেয়নি।’’
ভারতীয় রাজনীতিতে বফর্স পর্বের জন্ম হয়েছিল তিন দশক আগে। রাজীব গাঁধী তখন প্রধানমন্ত্রী। সুইডেনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক সংস্থা বফর্স থেকে ১৫০০ কোটি টাকার হাউইৎজার কামান কেনার চুক্তি করেছিল তাঁর সরকার। সেই সময়েই সুইডেনের একটি সংবাদপত্র অভিযোগ করে, ওই চুক্তির জন্য ভারতীয় রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীর কিছু কর্তা দালাল মারফত ঘুষ নিয়েছেন। সেই অভিযোগ নিয়ে তোলপাড়ের পরিণামেই ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে পতন ঘটে রাজীব গাঁধীর সরকারের। যার ক্ষত শুকোতে এক দশক কেটে যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হল, রাষ্ট্রপতি কেন এই মন্তব্য করলেন? চল্লিশ বছর ধরে কংগ্রেস রাজনীতি করেছেন প্রণববাবু। যে কোনও কংগ্রেসের নেতাই বফর্স কাণ্ড নিয়ে গাঁধীর পরিবার তথা দলের পক্ষে দাঁড়াবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এমন মন্তব্য করতে পারেন কি? জবাবে রাষ্ট্রপতির সচিবালয় জানাচ্ছে, সুইডেনের সংবাদপত্রের তরফে প্রশ্নটি করা হয় বলেই রাষ্ট্রপতি জবাব দিয়েছেন। তিনি নিজে থেকে ওই প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তোলেননি। তা ছাড়া প্রণববাবু সংবিধানের রীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। তিনি সত্যিকারের ছবিটা তুলে ধরেছেন। কোনও বিতর্কিত মন্তব্য করেননি।
কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি-ও রাষ্ট্রপতির এই মন্তব্য নিয়ে কোনও কাটাছেঁড়া করতে চায়নি। সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ সকালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রণব-মোদী কথোপকথনে এ প্রসঙ্গ উঠেছে কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতির মন্তব্য নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাব না।’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকরও বলেন, ‘‘বফর্স ভাল কামান। আর কিছু বলতে চাই না।’’ রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতি ঠিকই তো বলেছেন।’’ কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতার মতে, প্রণববাবুর সঙ্গে রাজীব গাঁধীর সঙ্গে এক সময়ে বনিবনা ছিল না ঠিকই। কিন্তু রাজীবের বহু সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন প্রণববাবু। তা ছাড়া প্রশাসনিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাঁর মানসিকতা রক্ষণশীল। দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার আগেই সংবাদমাধ্যমে লেখালেখির মাধ্যমে সেই কলঙ্ক চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে বরাবর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। হতে পারে বফর্স প্রসঙ্গে সেই অসন্তোষটাই ফের বেরিয়ে এসেছে।