জ্যোতি বসু থেকে সীতারাম, ভুলের পুনরাবৃত্তি!
রাজ্যসভায় সদ্য তখন পা রেখেছেন তরুণ মুখ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের রাজ্যসভার দলনেতা সীতারাম ইয়েচুরি তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘একশোটা ভুল হতে পারে। কিছু মনে করব না। কিন্তু একটা ভুলও আবার করা চলবে না!’’
নবীন সাংসদকে দেওয়া তাঁর সেই পরামর্শ মনে রাখল না সিপিএমই! এ বার খোদ ইয়েচুরির ক্ষেত্রেই। গোটা দেশের রাজনীতিতে যখন উথাল-পাতাল, একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতার দখল নিচ্ছে বিজেপি, রাজ্যসভায় প্রবেশ করছেন স্বয়ং অমিত শাহ— এমন একটা সময়ে ইয়েচুরির মতো বক্তাকে সংসদ থেকে সরিয়ে নিল সিপিএম! কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি পর্যন্ত ঘরোয়া আলোচনায় বাম নেতাদের বলছেন, ‘‘আপ লোগ পাগল হো ক্যয়া?’’
আরও পড়ুন- ইস্তফার চিঠি সীতার, ঠেকালেন বিমান-সূর্য
পাগল হোক বা না হোক, দশকের পরে দশক ধরে একই কাণ্ড ঘটিয়ে সিপিএম এখন ভুলের পাহাড়ে চড়ে বসেছে! নয়ের দশকে জ্যোতি বসুকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছিল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আপত্তিতে। তার পরে ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তির মতো আম জনতার কাছে দুর্বোধ্য বিষয়কে হাতিয়ার করে মনমোহন সিংহের সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিলেন প্রকাশ কারাটেরা। লোকসভার স্পিকার পদ না ছাড়ায় পত্রপাঠ বহিষ্কার করা হয়েছিল সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। এ বার কংগ্রেসের সমর্থন নিতে আপত্তি দেখিয়ে রাজ্যসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরিকে ফের প্রার্থী করতে অস্বীকার করেছেন কারাটেরা। যার জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া এখন দলের ভিতরে ও বাম মহলে। সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যাচ্ছে নিন্দার ঝড়ে।
বর্ষীয়ান নেতা সোমনাথবাবু যেমন সিপিএমের এই সিদ্ধান্তে ‘ব্যথিত’। হতাশ কণ্ঠে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বার বার করলে তাকে কি আর ভুল বলে? এটা তো মনে হচ্ছে সচেতন ভাবে করা হচ্ছে। এই ভাবে চললে দলটার অস্তিত্ব থাকবে?’’ প্রাক্তন স্পিকারের আরও আক্ষেপ, ‘‘এই দলটা করেছি ৪০ বছর। এ সব দেখতে কষ্ট হয়!’’ তাঁর বিস্ময়, সংসদীয় গণতন্ত্রে আছে, দেশের রাজনীতির কী অবস্থা, সবই সিপিএমের জানা। তবু তারা সীতারামকে সংসদে পাঠাবে না?
ইয়েচুরিকে সংসদে না পাঠিয়ে ফের কি ঐতিহাসিক ভুল করল সিপিএম? ছবি-পিটিআই
সোমনাথবাবু যে সচেতন ভাবে ভুলের প্রসঙ্গ তুলেছেন, দলের মধ্যে একাংশও একই গন্ধ পাচ্ছে। ওই অংশের বক্তব্য, সর্বভারতীয় একটি চ্যানেলের সঙ্গে কারাট পরিবারের সম্পর্ক নিয়ে নানা চর্চা আছে। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী সরকারের রোষের মুখে পড়েছে ওই চ্যানেল। এমতাবস্থায় বাংলায় বাম-সিপিএমের জোট ভেঙে দিতে সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের বড় অংশের সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে ওই ঘটনার যোগ আছে কি না, প্রশ্ন তুলছে দলের ওই অংশ। একই কারণে তাঁরা সংসদে মোদী-বিরোধী মুখ ইয়েচুরিকে আটকাতে মরিয়া হয়েছেন বলেও তারা দাবি করছে।
তাঁকে কী ভাবে দল থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল, সেই কাহিনি আজও ভোলেননি সোমনাথবাবু। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলে সিপিএমের বহু কর্মী-সমর্থকও সোমনাথবাবুর প্রসঙ্গ টেনে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাস্তববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর কথা। কারাটেরা ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পরে কংগ্রেসের হাত ধরে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ১ থেকে ১৯ আসনে পৌঁছেছিল। সুভাষবাবু তখন বলেছিলেন, কারাটের মতো তাত্ত্বিক নেতাদের উচিত ভোটে লড়ে আসা। জনতা এবং মাটি থেকে দূরে থাকা নেতাদের হাতে দলের নিয়ন্ত্রণ থাকলে পরিণতি দুঃখজনক হতে বাধ্য, বলেছিলেন তিনি।
আর এক প্রাক্তন নেতা সমীর পূততুণ্ডের মত, বার বার ভুল করেও রাজনৈতিক অবস্থানে মৌলিক কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি সিপিএম। ভুলের পাহাড়ে তারা চ়ড়ে বসায় দলের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, বাম আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমীরবাবুর এখনকার দল পিডিএস সিপিএমের সঙ্গেই আন্দোলনের মঞ্চে আছে। বৃহত্তম বামপন্থী দল হিসাবে সিপিএম ভুল করলে বাম আন্দোলন ধাক্কা খায় বলেই তিনি প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করছেন, যুক্তি সমীরবাবুর।
এখন সিপিএমকে সরাসরি কারাট-মুক্ত করার ডাকও সোশ্যাল মিডিয়ায় দিচ্ছেন কেউ কেউ। লেনিনকে উদ্ধৃত করে কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘তুমি যদি প্রয়োজনে লাইন পরিবর্তন করতে প্রস্তুত না থাকো, শত্রুকে তোমার দিকে টানতে তার সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রস্তুত না থাকো, তা হলে তুমি কোনও বিপ্লবী পার্টির নেতা হওয়ার যোগ্য নও’!
আর স্বয়ং ইয়েচুরি? দলের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে বসে তাঁকে বলতে হচ্ছে, ‘‘সাংসদ হওয়া বা পাটিগণিতের চেয়েও এই দলটায় এখনও রাজনৈতিক আদর্শ, নৈতিকতাই গুরুত্বপূর্ণ।’’ কিন্তু তিনি নিজেও জানেন, আগামী এপ্রিলে হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে তাঁর মুণ্ড চেয়ে তৎপর হবে কারাট ও কেরল শিবির। কেন্দ্রীয় কমিটির এ বারের বৈঠকের ফাঁকে কেরল হাউসে দক্ষিণী ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের সঙ্গে বৃন্দা কারাটের দীর্ঘ আলোচনাও দলের অনেকের ভ্রূ কুঞ্চিত করেছে। দলের একাংশ বলছে, এ বার মহিলা সাধারণ সম্পাদক চাই, এই মর্মে দাবি উঠতে শুরু করল বলে! জাতীয় রাজনীতিতে অস্বিত্ব টেকাতে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই দিতে যখন একজোট হয়ে কৌশল সাজানোর পালা, তখন গৃহযুদ্ধে বেলা বয়ে যাচ্ছে সিপিএমের!
ভুল শুধু? না বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি?