প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
আরব বিশ্বকে সঙ্গে রাখতে প্যালেস্টাইন নিয়ে ‘ইতি গজ’ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু হামাসের রকেট হামলার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একপেশে ইজ়রায়েল পন্থা, কংগ্রেস সরকারের তো বটেই, বিজেপি সরকারেরও আগের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। বলা হচ্ছে, এই ‘সরে আসার’ সিদ্ধান্ত সুচিন্তিত। একাধিক কারণে ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে ভারসাম্যের নীতিকে ঝেড়ে ফেলে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন মোদী। তার প্রথম কারণ অবশ্যই ২০২৪-এর নির্বাচন। মেরুকরণের প্রশ্নে আগামী দিনে যে হিন্দুত্বের ঝড় তুলতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব, এ তারই পূর্বাভাস। আজ যশোভূমি কনভেনশন সেন্টারে জি২০ দেশগুলির
সংসদীয় স্পিকারদের সম্মেলনে তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী ইজ়রায়েলে হামাসের আক্রমণের দিকে ইঙ্গিত করেই তীব্র ভাষায় সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী এই অল্প সময়ের মধ্যে দু’দুবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইজ়রায়েলপন্থী বিবৃতি দেওয়ার পাঁচ দিন পরে একটি প্রশ্নের উত্তরে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়েছেন, সব কিছুর পরেও সার্বভৌম, স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়ার প্রক্রিয়ায় ভারত উৎসাহ জুগিয়ে এসেছে। সেই অবস্থান একই রয়েছে।
কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, পশ্চিম এশিয়া তথা আরব রাষ্ট্রগুলির প্রতি মোদী সরকারের নির্ভরশীলতা ও সখ্যের খাতিরে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যেখানে ইজ়রায়েলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে তেল আভিভের পাশে থাকার স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন, সেখানে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের বক্তব্য নিষ্প্রভ হয়ে যাবেই। মোদী বার বার ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের ঘোর নিন্দা করছেন। কিন্তু প্যালেস্টাইনের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের কথা এক বারও উল্লেখ করেননি।
সূত্রের মতে, প্রথম কারণটি হল, ভোটের বালাই। চব্বিশের লোকসভার লড়াই কঠিন হবে বলেই মনে করছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। আর রাখ ঢাক না করে তাই হিন্দুত্বের ঝড় তোলাটাই এখন অগ্রাধিকার। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখে বিদেশ নীতিকে প্রণয়ন করার যে ভঙ্গি এই সরকারেরও কিছুটা ছিল, তা এই আপৎকালীন সময়ে প্রয়োজন নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। এটাও মাথায় রাখা হচ্ছে, ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতে ভারতের বিভিন্ন মুসলিম স্বর প্যালেস্টাইনের জন্য সহমর্মিতা জানাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে হামাসের জন্য আলাদা করে কোনও সহানুভূতি তাতে নেই।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের মাটিতে তৈরি হওয়া আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস নিয়ে দীর্ঘদিন জর্জরিত ভারত। ফলে হামাসের চরম বিরোধিতা শুধুমাত্র ঘরোয়া রাজনীতির জন্যও সুবিধাজনক নয়, ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যেও কড়া বার্তা। এর আগেও মোদী পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সম্ভাব্য সার্জিকাল স্ট্রাইককে, ইজ়রায়েলের গোপন অভিযানের সঙ্গে তুলনা করে সে দেশের সামরিক বিক্রমের প্রশংসা করেছেন।
তৃতীয়ত, সাউথ ব্লক এটা লক্ষ্য করেছে যে মিশর থেকে সৌদি আরব— আরবের বড় দেশগুলি এখনও হামাসকে পূর্ণ সহায়তার বার্তা দেয়নি। তারা মূলত ইজ়রায়েলের পাল্টা আক্রমণের সমালোচনা করে বলেছে, হিংসা বন্ধ করতে হবে। ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে সৌদি-সহ বেশ কিছু আরব দেশ। ফলে আরবের এ বিষয়ে কিছুটা সতর্ক প্রতিক্রিয়া, ভারতের কাছে সুবিধাজনক।
চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী হামাসের চরম নিন্দা করে কৌশলগত শরিক আমেরিকার কাছেও সদর্থক বার্তা দিতে চাইলেন বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের কিছুটা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে থাকা অবস্থান এবং নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে মস্কো থেকে তেল কেনার বিষয়গুলি ওয়াশিংটনকে অখুশি করেছে। এই পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে মোদীর হামাসকে নিশানা করা, বাইডেন প্রশাসনকে খুশি করবে।
তবে সংঘাত যদি বাড়তেই থাকে তা হলে ভারত এই অবস্থান কতটা ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আরব দেশগুলির সঙ্গে কত দূর পর্যন্ত কূটনৈতিক দরকষাকষি করতে পারে নয়াদিল্লি, সেটাও দেখার। কারণ পূর্ব এশিয়ার প্রতি বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভরতা রয়েছে মোদী সরকারের। এ ক্ষেত্রে হামাস এবং প্যালেস্টাইন-এর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা— দু’টি বিষয়কে আলাদা করে দেখার কৌশল নিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। অর্থাৎ, এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, হামাসের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে নিন্দা করছেন প্রধানমন্ত্রী, প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের দাবিকে অগ্রাহ্য করছেন না।
আজ জি২০ রাষ্ট্রগুলির স্পিকারদের সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বিদেশি অতিথিদের সামনে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গ তুলেছেন। মোদীর কথায়, “এখন বিশ্ব বুঝতে শুরু করেছে সন্ত্রাসবাদ সবার জন্যই এক বিপদ। তা সে যেখানেই ঘটুক, তার পিছনে কারণ যাই হোক, আজ এটা স্পষ্ট যে সন্ত্রাসবাদ মানবতার বিরোধী। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে লড়তে হবে।” তাঁর কথায়, “সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের অভাব অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এমনকি আজও রাষ্ট্রপুঞ্জের সন্ত্রাসবাদ মোকবিলার মঞ্চে ঐকমত্য গড়ে উঠল না। এর সুযোগ নিচ্ছে মানবতার শত্রুরা।”
জি২০-র বৈঠকে এ দিন সামগ্রিক ভাবে সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা হলেও ইজ়রায়েল-হামাস সংঘর্ষের উল্লেখ করা হয়নি ইন্দোনেশিয়ার আপত্তিতে। একই ভাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও বাহরিন ছাড়া সব আরব দেশই মোদীর নতুন ইজ়রায়েল-পন্থী অবস্থানে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।