ছবি: পিটিআই।
দলিত-বিক্ষোভে দিনভর উত্তাল গুজরাত! ঝড় সংসদেও। রোহিত ভেমুলা কাণ্ডের পর এ বার তাঁর নিজের রাজ্যেই দলিত নির্যাতনের অভিযোগে প্রবল অস্বস্তিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
গুজরাতের উনায় চার দলিত যুবককে মারধরের প্রতিবাদে সংসদে আজ তুমুল হইচই বাধায় কংগ্রেস ও অন্য বিরোধী দলগুলি। যা ধামাচাপা দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে বলতে হয়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ঘটনায় দুঃখিত ও আহত। তিনি কড়া ভাষায় এর নিন্দা করেছেন।’’
ঘটনার সূত্রপাত গত ১১ জুলাই। গুজরাতে গির-সোমনাথ জেলার উনা শহরে গরুর চামড়া ছাড়ানোর কাজ করতে গিয়ে মার খান চার জন দলিত যুবক। ওই যুবকদের দাবি, গরুটি স্বাভাবিক কারণে মারা গিয়েছিল। এর পরে তাঁরা চামড়া ছাড়াচ্ছিলেন। তবু গোহত্যার অভিযোগ তুলে রাস্তায় নগ্ন করে লোহার রড দিয়ে ওই যুবকদের বেধড়ক মারধর করে স্থানীয় গো-রক্ষা সংগঠনের কিছু সদস্য। গাড়ির সঙ্গে চেন দিয়ে বেঁধে তাঁদের হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় থানায়। তার ভিডিও সোশ্যাল মি়ডিয়ায় ভাইরাল হতেই প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে আগামী কাল গুজরাতে যাওয়ার কথা কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর। পরশু যাবেন আম আদমি পার্টির নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল।
বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী জমানায় বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ব ও গরুর রাজনীতির জন্যই দলিতদের উপর নির্যাতন বেড়েছে। সংসদে কংগ্রেস আজ অভিযোগ তোলে, বিজেপি ‘দলিত-মুক্ত ভারত’-গড়ার চক্রান্তে মদত দিচ্ছে। সঙ্ঘ-পরিবারের সংগঠনগুলি উত্তরপ্রদেশে ভোটের মেরুকরণ করতে গো-রক্ষার রাজনীতি করছে। তার ফলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। গুজরাতে দলিতরা আত্মহত্যা করছেন বলেও অভিযোগ তোলেন কংগ্রেস নেতারা। উনার ঘটনার তদন্তে যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ারও দাবি ওঠে।
সরাসরি মোদীর দিকে তির ঘুরে যাচ্ছে দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ যুক্তি দেন, কংগ্রেস আমলে গুজরাতে দলিতদের উপর নির্যাতন হতো। ২০০১-এ মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সেই ঘটনা কমেছে। যদিও এখন আনন্দীবেন পটেলের জমানায় গুজরাতে দলিত-পীড়নের ঘটনায় মোদী যে দুঃখিত ও আহত, সে কথাও স্বীকার করতে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। সংসদেই রাজনাথ জানান, যে রাজ্যেই দলিতদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটুক, মোদী সরকার তা খতিয়ে দেখবে। উনার ওই ঘটনায় ইতিমধ্যেই ন’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৪ পুলিশকর্মী সাসপেন্ড হয়েছেন। তৈরি হয়েছে বিশেষ আদালত। সিআইডি-কে এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে কড়া অবস্থান নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন। আজ উনা-কাণ্ডে নির্যাতিতদের বাড়ি যান মুখ্যমন্ত্রী। সুবিচারের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘দলিতদের যে ভাবে মারধর করা হয়েছে, তা চোখে দেখা যায় না। সভ্য সমাজে এমন ঘটনা ঘটে না। অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষে যা যা পদক্ষেপ করা সম্ভব, সব করা হয়েছে।’’
প্রশাসনিক তৎপরতা ও মুখ্যমন্ত্রীর ওই আশ্বাস সত্ত্বেও গুজরাতের একটা বড় অংশ আজ দিনভর ছিল রণক্ষেত্র। উনা-কাণ্ডে সুবিচার এবং দলিতদের অধিকারের দাবিতে কার্যত তাণ্ডব চালায় বিক্ষোভকারীরা। উত্তাল হয়ে ওঠে আমরেলি, জুনাগড়, ঢোরাজি, ঢোরল, জামনগর, রাজকোট। দলিত নির্যাতনের প্রতিবাদে গত চব্বিশ ঘণ্টায় ১২ জন যুবক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। পুলিশ ও সরকারি কর্তাদের লক্ষ করে ছোড়া হয় ইট-পাটকেল। ইটের ঘায়ে মারা যান এক পুলিশ। মরা গরুর দেহ ফেলে রেখে চলে বিক্ষোভ।
বিক্ষোভকারীদের ডাকা বন্ধে উত্তর গুজরাতের বেশির ভাগ এলাকাতেই বিপর্যস্ত হয় পরিবহণ, চলে অবরোধ, বেরোয় প্রতিবাদ মিছিল। রাস্তায় রাস্তায় চলে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। স্কুল-কলেজ থেকে সরকারি অফিস ছিল বন্ধ। অশান্তি ঠেকাতে এ দিন বেশ কয়েকটি রুটের বাস বন্ধ রাখে প্রশাসন। রাজকোটে জনা পঞ্চাশ বিক্ষোভকারীকে আটকও করে পুলিশ। বিক্ষোভের আঁচ আমদাবাদে ছড়ালেও আপাত ভাবে শহর শান্তিপূর্ণই ছিল। কিছু কিছু এলাকা দলিত আন্দোলনকারীরা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়।
পুলিশের অবশ্য দাবি, রাজ্যের কিছু অংশে দলিত-বিক্ষোভ চললেও তার প্রভাব সারা রাজ্যে পড়েনি। তবে সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় সূত্র বলছে, দলিত-সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের মরিয়া চেষ্টা সত্ত্বেও বিক্ষোভের আঁচ এতটুকু কমেনি!