Indian Education System

‘আফগানিস্তানের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলি, নিজেদের নয়’

১৯৯১ সালে বিজ্ঞানে অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পেয়েছিলেন দীপক। ২০০২ সালে পান ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ পুরস্কার।

Advertisement

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৩ ০৭:৫৩
Share:

এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টারে বিজ্ঞানী দীপক ধর। নিজস্ব চিত্র।

‘‘যদি যোগ্য হও, কেউ হারাতে পারবে না, সাফল্য আসবেই। হয়তো একটু বেশি লড়তে হতে পারে...।’’ এমনটাই মনে করেন দেশের প্রথম বোলৎজ়ম্যান পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানী দীপক ধর। ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিজ়িক্স’ বিষয়ে বিশ্বে সর্বোচ্চ সম্মান এটি। গত বছর যা পেয়েছেন এই পদার্থবিজ্ঞানী। সম্প্রতি ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস’ আয়োজিত সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্মারক বক্তৃতা দিতে কলকাতায় এসেছিলেন পদ্মভূষণ সম্মানপ্রাপ্ত এই পদার্থবিজ্ঞানী। জানালেন, এ দেশে সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ায় গলদ রয়ে গিয়েছে। বহুলাংশে দায়ী সমাজও। তাই দেশের মানুষের বহু প্রাপ্তিই এখনও অধরা।

Advertisement

১৯৯১ সালে বিজ্ঞানে অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পেয়েছিলেন দীপক। ২০০২ সালে পান ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ পুরস্কার। তাঁর সম্মানের ঝুলি প্রায় পরিপূর্ণ। গত বছর তিনি, ভারতীয় হিসেবে প্রথম, বোলৎজ়ম্যান পুরস্কার পেয়েছেন। স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিজিক্স বিষয়ে ১৯৭৫ সাল থেকে প্রতি তিন বছর অন্তর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এই সম্মান অর্জনে কেন এত সময় লাগল ভারতের? কেনই বা নোবেল পুরস্কার জয়েও হাতেগোনা কিছু ভারতীয় নাম?

দীপক সেখানে বেশ ব্যতিক্রমী একটি নাম, যিনি আগাগোড়া দেশেই কাজ করেছেন। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক, তার পর কানপুর আইআইটি-তে স্নাতকোত্তর। পিএইচডি করতে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক)-তে গিয়েছিলেন। তবে পাঠ শেষ করে ফিরে আসেন দেশে। যুক্ত হন ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ (টিআইএফআর)-এর সঙ্গে। ২০১৬ সালে সেখান থেকে অবসর নেন। ৭১ বছর বয়সি দীপক এখন অধ্যাপনা করছেন আইআইএসইআর, পুণেতে। দেশের মাটিতে কাজ করেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘স্যান্ডপাইল মডেল’। বালির স্তূপের কৌণিক ঢাল বেয়ে যে সবিরাম প্রবাহ (ইন্টারমিটেন্ট ফ্লো) তৈরি হয়, তার ব্যা‌খ্যা দেয় এইমডেল। ‘ফেজ় ট্রানজ়িশন’, ‘সেল্‌ফ অর্গানাইজ় ক্রিটিক্যালিটি’, ‘পারকোলেশন’ থিয়োরি নিয়ে কাজ করেছেন দীপক।

Advertisement

ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’, ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’ এবং ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর নির্বাচিত সদস্য (ফেলো) দীপক। তাঁর মতে, একটি ছোট শিশুর যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, এ দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে সেটা পায় না। তাঁর কথায়, ‘‘আমেরিকা, ইউরোপের কোনও দেশে ধরা যাক ৮ বছরের কোনও বাচ্চাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন তোমার সাঁতার ভাল লাগে, তারা কেউ বলবে আমার গায়ে-মুখে জল লাগলে ভাল লাগে, আমার আনন্দ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একই প্রশ্ন করা হলে বাচ্চারা বেশির ভাগ সময়ে চুপ করে থাকে। এর কারণ, ধরাবাঁধা বিষয়ের সীমিত গণ্ডিতে বাচ্চাদের ভাবনাচিন্তার গতিপথ বেঁধে দেওয়া হয়। অনেক সময়ে সমাজই হয়তো চায় না, মানুষ স্বাধীন ভাবে ভাবতে শিখুক।’’ এ জন্য সমাজের মানসিকতা বদলানো প্রয়োজন বলে মনেকরেন দীপক। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক সময় সরকার নয়, সাধারণ মানুষই দায়ী। তাঁরা হয়তো শুধু টাকাপয়সার পিছনে ছুটছেন।’’

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলেও মনে করেন দীপক। তাঁর কথায়, ‘‘উচ্চশিক্ষার জন্য লোকজন বিদেশ চলে যাচ্ছেন। অলিম্পিকে মেডেল আনার জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, পরিকাঠামা যদি দেশে তৈরি করা যায়, তা হলে অনেক ভাল হয়।’’ প্রবীণ বিজ্ঞানীর মতে, শিক্ষা-খাতে সরকারের আরও বেশি বিনিয়োগ করা দরকার।

সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ (এনসিইআরটি) স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে জীব বিবর্তন তথা ডারউইনিজ়ম বাদ দিয়েছে। দীপক বলেন, ‘‘দেশের নেতারা যদি শিক্ষাব্যবস্থাকে গুরুত্ব না দেন, তা হলে তা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আমরা আফগানিস্তানের নারীশিক্ষা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে পারি, কারণ সেটা অন্য দেশ। কিন্তু নিজের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করি না।’’ তবে দীপক মনে করেন সব সময় সরকারকেও দায়ী করা যায় না। তাঁর কথায়, ‘‘হয়তো একটি স্কুলে এক জন মাত্র শিক্ষক। নিঃসন্দেহে খারাপ পরিস্থিতি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যাবে, সেই এক জন শিক্ষকও স্কুলে আসেন না।’’

প্রবীণ বিজ্ঞানীর আর্জি, শুধু অর্থের পিছনে না-ছুটে, যেটা ভাল লাগে, সেই পেশা বেছে নেওয়া উচিত পড়ুয়াদের। মা-বাবাদেরও সে বিষয়ে সন্তানদের উৎসাহ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘‘আমরা থ্রি-ইডিয়টস ফিল্মটি দেখে বাহ্‌ বাহ্‌ করেছি, কিন্তু কিছু শিখেছি কি!’’ এস এন বোস সেন্টারের ডিরেক্টর, অধ্যাপিকা তনুশ্রী সাহা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘স্বপ্ন দেখতে হয়। উত্তরপ্রদেশের একটা ছোট্ট শহর থেকে উঠে এসে এত বড় স্বপ্ন ছোঁয়া যে সম্ভব, সেটা কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক দীপক ধর।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement