প্রাক্তনকে শ্রদ্ধা বর্তমানের। এ পি জে আব্দুল কালামকে গার্ড অব অনার দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার দিল্লি বিমানবন্দরে। ছবি: পিটিআই।
কী বলা যাবে একে? অন্তিম যাত্রার আগে তাঁকে শেষ বারের মতো দেখতে চাওয়া? শ্রদ্ধা জানানো? নাকি শেষযাত্রার প্রাক্ মুহূর্তেও তাঁর জীবনের উদ্যাপন?
তাঁর সম্পর্কে ‘মিসাইল ম্যান’ নামটা শুনতে যান্ত্রিক! কিন্তু ভিতরের মানুষ কতটা ছুঁয়ে গিয়েছিলেন আমজনতাকে, আজ দেখল লুটিয়েন দিল্লি। দশ নম্বর রাজাজি মার্গের ঔপনিবেশিক স্থাপত্যে মোড়া দোতলা বাড়িটি ছিল তাঁর এত দিনের সরকারি বাসভবন। আর আজ নীচের তলার বৈঠকখানায় তিন বাই সাড়ে ছয় ফুট ডিভানে শায়িত তিনি। তেরঙ্গা পতাকায় মোড়া। মুখ ঢাকা স্বচ্ছ পলিথিনে। ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি আবুল পকির জয়নুলাবদিন আব্দুল কালাম।
বৈঠকখানার ঘর থেকে পশ্চিমে উঠোনের দিকে একটা দরজা। সেই উঠোনেই সাদা শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। গিটার বাজিয়ে কোরাসে গান চলছে অবিরাম, জিনা ইসিকা নাম হ্যায়/ জিনা আব্দুল কালাম হ্যায়।
রাইসিনা হিলসের সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ঠিক পিছনের উঠোনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল। সেখান থেকে সর্পিল লাইন ডিআরডিও অফিসের কোল ঘেঁষে চলে গিয়েছে দশ নম্বর রাজাজি মার্গের গেটের দিকে। কম করে দেড় কিলোমিটার। সকাল থেকেই রেডিও, টিভিতে ঘোষণা হয়েছে, বিকেল চারটের পর সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ দেওয়া হবে। সে খবর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি আইআইটি, রাজধানী এলাকার বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার দফতর, সরকারি অফিসের বারান্দা, নয়ডা-গুড়গাঁওয়ের বহুজাতিক সংস্থার অফিস-কাছারিতে ছড়িয়ে পড়তে যেটুকু সময় লাগে। তার পর আয়ুষ্মান, অভিজ্ঞান, রীতেশ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। দেরিতে এলে যদি ‘মিস’ হয়ে যায়! জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিন ছাত্র এক বার কালামের বক্তৃতা শুনেছিলেন। তার পর থেকেই তাঁরা কালামের বিরাট ‘ফ্যান’। ল্যাপটপের ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে গুড়গাঁওয়ের তথ্য প্রযুক্তির অফিস থেকে মেট্রো চেপে চলে এসেছেন মেহক ও মীরা। হাফ ছুটি করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন সুবোধ শর্মা। তারপর ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছেন রাজাজি মার্গে। ছেলের বড় হয়ে এয়ারোনটিক ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সখ। ওকে বলেছেন, ‘‘চল্, এর পর আর ওঁকে দেখতে পাবি না।’’ আবার রাকেশ হরি তাঁর অন্ধ ছোট বোনকে নিয়ে এসেছেন ‘হোয়াট ক্যান আই গিভ মোমেন্ট’ (২০১২ সালে যুব সম্প্রদায়কে নিয়ে এই অভিযান শুরু করেছিলেন কালাম, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি দমন) অভিযানে ওঁর ‘লিডারকে’ দেখাতে।
আরও ছিলেন। বেশ কয়েক জন খ্রিস্টান পাদ্রি, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, কয়েক জন মৌলবিও। এক দিকের লাইন অতিরিক্ত দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায়, সন্ধ্যায় সফদরজঙ্গ রোডের দিক থেকে নতুন লাইন করা হয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির দেহের সামনে অবশ্য কাউকে এক সেকেন্ডের বেশি দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। পিঠে আলতো চাপড় মেরে সরিয়ে দিচ্ছেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তোলাও বারণ। তাই সই। দেখা যে হল, এতেই খুশি সবাই।
হ্যাঁ খুশি। কারণ, এত মানুষের মাঝে শোকে ভেঙে পড়ার ছবি প্রায় নেই বললেই চলে। দুঃখ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাকে ছাপিয়ে বার বার বেরিয়ে এসেছে ১৫ থেকে ৩৫-দের আবেগ, উন্মাদনা ও কালাম নামক মানুষটার জীবনকে ঘিরে উদ্যাপনের ছবি। পর পর দু’বছর এম টিভি-র সমীক্ষায় ইয়ুথ আইকন হয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। আজকে সেই ইতিহাস ফের প্রাসঙ্গিকতা পেল।
গুয়াহাটি থেকে আজ সকালে বায়ুসেনার বিমানে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির দেহ দিল্লিতে আনা হয়। তার পর দিল্লি বিমানবন্দরে তাঁকে গার্ড অব অনার দেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি। পরে তাঁরা ফের রাজাজি মার্গে গিয়ে কালামকে শ্রদ্ধা জানান। পরে সনিয়া ও রাহুল গাঁধী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সপা নেতা মুলায়ম সিংহ থেকে শুরু করে বহু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে যান। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি জানিয়েছেন, সরকারি প্রকল্প ‘রাষ্ট্রীয় আবিষ্কার যোজনার’ নাম কালামের নামে নামকরণ করার ব্যাপারে প্রস্তাব করবেন তিনি।
সরকারি সূত্রে খবর, রাজাজি মার্গের বাসভবন থেকে কাল দুপুরে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে রামেশ্বরমে। পরশু সকাল ১১টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধি দেওয়া হবে। কৌতুহল থেকে যায়! শেষ কবে কোনও প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির শেষযাত্রায় এমন হয়েছিল? প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের মৃত্যুর পরে দিল্লির রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল, বলছেন প্রবীণ রাজনীতিকরা। কিন্তু তার পর আর কোনও রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে এমন উন্মাদনার কথা স্মরণ করতে পারছেন না কেউই!
যখন মৃত্যুর পরেও জীবন নিয়ে এমন উদ্যাপন হয়েছিল!