Gujarat Assembly Election 2022

চাপা পড়ে আর্তস্বর, সেতু ঘিরে ভোটের ‘শান্তি’

ফিরে আসার আগে আর এক বার দূর থেকে চোখ রেখে দেখি, নদীর ধারে নিশ্চিন্তে বকগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছে একইরকম ভাবে। অন্তত এ বারের মোরবীর যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ হোক— এমনটাই কি চাইছে তারা নিরুচ্চারে!

Advertisement

অগ্নি রায়

মোরবী শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২২ ০৬:১৯
Share:

সেই সেতু এখন। নিজস্ব চিত্র।

এখানে শোকের চিহ্ন আগলে কচুরিপানা ছুঁয়ে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে বক। জল ছুঁয়ে একটি দূরে উড়ে গিয়ে বসল।

Advertisement

কী বলছে ভোটের বাজারে এই বকগুলির ধর্মবোধ? ওই যে উপর থেকে এখনও শূন্যে দোল খাচ্ছে তারের জটাজাল, এই যে শ্মশান-শান্তির জলমহলে ডাকাডাকিতে ব্যস্ত পাখিরা— সেই সলিল সমাধির ভয়ঙ্কর আর্তনাদ থেকে তারা আসলে কত দূরে আসতে পারল? না কি, ভেঙে পড়া মাচ্ছি সেতুর (ঝুলতো পুল) অনতিদূরে, সমান্তরাল মোরবী সেতুর উপর দিয়ে ভোটবাবুদের সদর্প প্রচার-পর্যটনের নির্লজ্জতার বিরুদ্ধে এ এক পাল্টা প্রতিবাদ? ‘মাচ্ছু মা মন্দিরের’ পাশ থেকে আবর্জনাময় ঢালু মাটি-পাথর জংলা এলাকা দিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে (কারণ, মূল সেতু বন্ধ) এসে দাঁড়িয়েছি শূন্যতার গ্রাউন্ড জিরোয়। অতীতের সেতুটির এক দিকে দরবারগড়, অন্য দিকে নজরবাগ রাজবাড়ি। মাঝে আকাশের গায়ে আঁচড়ের মতো কিছু ইস্পাতের সুতো ঝুলছে। ঋতু বদলাচ্ছে, ফলে এখন জল কমেছে এই মাচ্ছু নদীতে। যে টুকু আছে মূল সেতুর দু’দিকে, সেখানে ঘাই মারছে মাছ। আর এখানে দাঁড়ালে চামড়া খুব মোটা না হয়ে গেলে, চেতনায় ঘাই মারতে বাধ্য গত এক মাসে ভিডিয়ো এবং স্থিরচিত্রে বার বার দেখা সেই ভয়ঙ্কর ফ্রেমগুলি।

এই সব ফ্রেম মোরবীর সেতু সংলগ্ন মহলে স্থায়ী গল্প হয়ে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কিন্তু মোরবী বিধানসভা ভোটের সঙ্গে তার খুব একটা বিরাট সম্পর্ক থাকবে বলে তো মনে হল না। গত এক মাসে কিছুটা বাড়তি উদ্যোগী হয়ে ফোটানো পদ্মে ভরে রয়েছে মোরবী নগর, এক কিলোমিটার দূরে দূরেই বিজেপি-র পতাকাশোভন প্রচারকেন্দ্র। শেষ মুহূর্তে বিজেপি তার প্রার্থী বদলে দিয়েছে বটে, কিন্তু তা না দিলেও শৌর্য এবং পরাক্রমে তারা এখানে এখনও এগিয়েই। সেতু ঘিরে এতটাই প্রগাঢ় শান্তির বাতাবরণ যে তন্নতন্ন করে খুঁজে অশ্বত্থগাছের ছায়ায় একটি অটোয় এক জন পুলিশকে দেখা গেল। তিনিও পিছনের সিটে আধশোওয়া হয়ে মোবাইলে তন্ময়।

Advertisement

তা বলে কি ক্রোধ নেই? আর্তস্বর নেই? শোক নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু যাঁদের জেবের শক্তি খুবই কম, তাঁদের শোক বা ক্রোধকে কিনেও তো নেওয়া যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে! সেতু থেকে পাঁচশো মিটার দূরে মহম্মদ আনিসের চা এবং পানের দোকান। এক বার প্রশ্ন করতেই যে ভাবে বলতে শুরু করলেন সেই সন্ধ্যার সেতু-বিপর্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ, বোঝা গেল এই চার সপ্তাহে অন্তত একশো বার তিনি তা বলেছেন দেশবিদেশ থেকে আসা সংবাদমাধ্যমকে। নবরাত্রির পরে তখন পর্যটন এবং বাণিজ্য ঢিলে, তবে মোরবীতে তখনও উৎসবের রেশ। বিশেষ করে ১৪২ বছরের প্রাচীন এই সেতুটি মেরামতের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার আগেই খুলে দেওয়ায় স্থানীয় উচ্ছ্বাস, সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার ধুম। “ঠিক সূর্যাস্তের সময় যে পিলে চমকানো আওয়াজ শুনলাম, তা এর আগে জীবনে কখনও শুনিনি।” বলছিলেন আনিস। “দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে দেখি মহাবিপর্যয়। কিছু মানুষ প্রাণপণে ওই মর্চে ধরা রড তারগুলি ধরে ঝোলার চেষ্টা করছেন। বেশির ভাগ তলিয়ে যাচ্ছেন। নদীতে আজকের থেকে অনেক বেশি জল ছিল তখন। আমি ঝাঁপাই, আশপাশের অনেকেই। কিন্তু যে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তত ক্ষণে, তার তুলনায় কত জনকেই বা বাঁচাতে পেরেছি।”

ওই দোকানে ঝিম মেরে বসে আরও চার-পাঁচ জন। তার মধ্যে এক জন, শীর্ণ শরীরের নবীন ভাইয়ের ভিতরে আগুন জ্বলছে এখনও। “সবটাই একটা ধাপ্পাবাজি। বিজেপি সরকারের দুর্নীতির চক্করে এত এত মানুষ মরল। এখনও কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে? আসল দোষীদের গ্রেফতার করল কোথায়? সবই ভোটের আগে লোক দেখানো।” তার পাশেই বসেছিলেন স্থানীয় সেরামিক কারখানার সুদেশ পটেল। একেবারে হায় হায় করে উঠলেন। “এই সব নিয়ে এখন বলে কী লাভ। যখন ভগবান ডেকে নিয়েছেন, তখন মানুষ কি কিছু করতে পারে!”

এমনিতেই সতেরোর ভোটের মতো বিজেপি-বিরোধী হাওয়া দৃশ্যত এ বার গুজরাতে নেই। যা আছে, তা চোরাস্রোত। তবে ভেঙে পড়া সেতু আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি-র সম্ভাবনাকে ভঙ্গুর করে দিতে পারে, এটা বুঝে মোদী-শাহের দল আরও বেশি সক্রিয় এই এলাকায়, এমনটাই জানাচ্ছেন এখানকার সাধারণ মানুষ। রাহুল গান্ধীও রাজকোটে এসে প্রসঙ্গটি তুলে সরাসরি আক্রমণ করেছেন মোদীকে।

এই বিধানসভা আসনটি সৌরাষ্ট্রের অংশ। কংগ্রেস মনে করিয়ে দিতে চাইছে, গত বিধানসভায় এখানকার মোট ৫৬টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসনই পেয়েছিল কংগ্রেস। মোরবী জেলার তিনটি আসনই (মোরবী, তানকারা, ওয়াঙ্কানের) পেয়েছিল কংগ্রেস। তবে ২০২০ সালে মোরবা থেকে জেতা কংগ্রেসের ব্রিজেশ মিশ্র দল বদলে চলে যান বিজেপি-তে, উপনির্বাচনে জিতেও আসেন। মোরবী দুর্ঘটনার আগে তাঁরই দাঁড়ানোর কথা ছিল স্বাভাবিক ভাবেই। তবে ক্ষত মেরামতির চেষ্টায় তাঁকে সরিয়ে নতুন মুখ, কান্তিলাল শিবলাল ভাইকে দাঁড় করিয়েছে বিজেপি।

ফিরে আসার আগে আর এক বার দূর থেকে চোখ রেখে দেখি, নদীর ধারে নিশ্চিন্তে বকগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছে একইরকম ভাবে। অন্তত এ বারের মোরবীর যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ হোক— এমনটাই কি চাইছে তারা নিরুচ্চারে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement