ফাইল চিত্র।
বাতাসে বারুদের বাস। এক রাশ আতঙ্ক-উদ্বেগ-আশঙ্কা মাথায় নিয়ে প্রতি রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে যে শহর প্রার্থনা করে, ভোরের আলোয় যেন দেখতে না হয় নতুন কোনও সন্ত্রাস। কোনও মায়ের কোল যেন হঠাৎ করেই খালি না হয়। যেন আইস্যাফ-এর (ইন্টারন্যাশনাল সিকিয়োরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স ফোর্স) কনভয় নগর পরিক্রমা শুরু না করে। তালিবান শাসনের প্রথম সংস্করণ উৎখাত হওয়ার পর একবিংশ শতকের সূচনা লগ্নে এমনই ছিল কাবুল শহরের প্রতিদিনের প্রার্থনা।
সেই আবহে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে ভারত সরকার কয়েক জন বিশারদকে সে দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আসমাই পাহাড়ের পাদদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাবুল শহরে পৌঁছনোর পর হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল, বিশারদ হওয়ার বিড়ম্বনা কারে কয়। দম বন্ধ পরিবেশ। এ দিকে যাওয়া চলবে না। ও দিকে চলা নিষেধ। প্রতিটি পদক্ষেপের আগে নিতে হবে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাবুল দফতরের অনুমতি। এমনকি, চুল কাটানোর জন্যও নিতে হয় আগাম অনুমোদন। সঙ্গে থাকে নির্দেশ, কোথায় কখন যেতে হবে এবং কোন নিরাপত্তা কর্মী সঙ্গে থাকবেন।
তবুও ঘটনা ঘটে। মাঝেমধ্যেই আত্মঘাতী বিস্ফোরণের খবর আসে। শহরের বাস টার্মিনাস থেকে শুরু করে পুলিশের সদর দফতরের আঙিনা, কিছুই বাদ যায় না। তড়িঘড়ি পুলিশ বাহিনী এলাকাটি ঘিরে ফেলায় কিছু ক্ষণের জন্য স্থানীয় দোকানপাট-আপিসকাছারি এবং যান চলাচল বন্ধ থাকে। তার পরই সব কিছু স্বাভাবিক। রেডিয়ো-টেলিভিশন জানান দেয়, অমুক জায়গায় একটা বিস্ফোরণে অত জন মারা গেছে। ওই পর্যন্তই। সংখ্যাই শেষ কথা। নিহতদের নাম-ঠিকানা-পরিচয় জানানোর বালাই নেই। এই ভাবেই তালিবানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কাবুল শহরের দিন কাটে। অন্তত দুই দশক তো এই ভাবেই পেরিয়ে গেল সন্ত্রাস মুক্ত অথবা সন্ত্রাস যুক্ত কাবুল।
তবুও সন্ত্রাসকে নিত্য সঙ্গী করে কাবুলের সমাজ জীবনে মুক্তচিন্তার হাওয়া বইতে শুরু করেছিল। সকালে গুটি গুটি পায়ে স্কুলের দিকে রওনা দেয় কাবুলের শৈশব। একটু বেলায় শিশুরা যখন স্কুল ছুটির পর বাড়ির দিকে ফিরে আসছে, তখন সেই পথেই স্কুলের দিকে এগিয়ে যায় কাবুলের কৈশোর। তারা যে উঁচু ক্লাসের পড়ুয়া। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা অবশ্য স্টুডেন্ট স্পেশাল বাসে যাতায়াত করে। সকাল সাড়ে আটটার একটু আগে যে কোনও সরকারি দফতর বা ব্যাঙ্কের সামনে পৌঁছে যায় বাস অথবা মিনিবাস। পুরুষদের সঙ্গে নেমে আসে এক ঝাঁক বোরখা। অনেকের কোলে সন্তান। একটু বড়রা অবিশ্যি মায়ের হাত ধরেই বাস থেকে নামে। দফতরের ক্রেশে বাচ্চাদের পৌঁছে দিয়ে তবেই না শুরু করা যাবে দিনের কাজ। তবে কাজে হাত লাগানোর আগে বোরখা খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে দিতে কখনও ভুল হয় না। ওই যেমন ভাবে পুরুষ কর্মীরা চেয়ারে কোট ঝুলিয়ে দেয়, সেই রকম।
কাজের ফাঁকে সহকর্মীরা মাঝেমধ্যে শোনাতে থাকেন বিংশ শতাব্দীর তালিবান আমলের কাহিনি। কী ভাবে বিকশিত হয়েছিল তাঁদের কৈশোর। যাঁদের বয়স একটু বেশি, তাঁরা শোনান গৃহযুদ্ধের কাহিনি। কার বাড়ির দেওয়ালে এখনও বুলেট গেঁথে রয়েছে কিংবা কার মহল্লায় কত জন তালিবানের অনুশাসনে মারা গিয়েছিলেন। বাড়িতে বসে মেয়েদের পড়াশোনা করার খবর পেয়ে কার বাড়িতে হানা দিয়েছিল তালিবান বাহিনী। এই সব কাহিনি বিদেশি সহকর্মীকে শুনিয়ে বোধ হয় তাঁরা বোঝাতে চাইতেন, কোন পরিস্থিতির মধ্যে তাঁরা লেখাপড়া শিখেছেন। প্রতি মুহুর্তের আতঙ্কের মধ্যে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত সাধারণ কাবুলিদের চোখেও ভেসে বেড়ায় শান্তিতে ঘরসংসার করার স্বপ্ন। আর মনে মনে ভাবেন, আবার যেন গোলাগুলির দিন ফিরে না আসে। আবার যেন অনুশাসনের দাপটে অবরুদ্ধ না হয় তাঁদের জীবনযাপন।
শেষ পর্যন্ত তালিবানের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর কাবুলের দিনগুলোর কথা বেশি করে মনে পড়ছে। জানতে ইচ্ছে করছে, এক দল ঝকঝকে প্রাণোচ্ছল এবং দক্ষ কর্মীকে ঘরে বসিয়ে রেখে কী ভাবে চলবে ব্যাঙ্ক, টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজ প্রভৃতি পরিষেবার কাজ এবং সরকারি দফতর। শিক্ষার আঙিনা অথবা ক্রীড়াঙ্গন অনেকের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে গেলে কী করে এগিয়ে যাবে আগামী দিনের আফগানিস্তান?
এই রকম হাজারো প্রশ্নের জালে জড়িয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ে গেল, কাবুলকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসার মুহূর্ত। সকলে হাতজোড় করে প্রায় একযোগে বলেছিলেন, ‘‘স্যর, আল্লার কাছে আমাদের জন্য একটাই দোয়া করবেন, তালিবানের যুগ যেন ফিরে না আসে।’’
(লেখক : ভারত সরকারের যোজনা কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক। আফগানিস্তান সরকারের উপদেষ্টা পদে কাবুলে কর্মরত ছিলেন)