প্রথমে ঠিক ছিল মৌর্য হোটেল থেকে গাড়িতে করেই গাঁধী ময়দানে আসবেন তিনি। কিন্তু কেজরীবালের সঙ্গে বৈঠক করতে করতে মমতা তাঁর ৪০১ নম্বর স্যুটে বসেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে হোটেল থেকে হেঁটে হেঁটে পদযাত্রা করে পৌঁছে যাবেন ঐতিহাসিক গাঁধী ময়দান। রাজি হয়ে গেলেন অরবিন্দ কেজরীবাল।
গাঁধী ময়দানের শপথগ্রহণের পর এক নম্বর অ্যানে মার্গে নীতীশ কুমারের বাড়িতে চা-চক্র। সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন রাহুল গাঁধী। রাহুল রয়েছেন বলেই হয়তো গরহাজির কেজরীবাল। মমতার এ সবে কোনও সমস্যা নেই। রাহুল মমতাকে দেখে নিজেই উঠে এলেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। একসঙ্গে বসে দু’জনের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হল। অনেকদিন পর একান্তে আলাপচারিতা। কী হল, তা জানা গেল না। কিন্তু নীতীশ যখন মমতাকে কিছু খেতে অনুরোধ করলেন, কিছু না খেলে অন্তত ডাবের জল বা ডায়েট কোক, তখন রাহুল মমতাকে বললেন, আপনি শরীরের প্রতি যত্ন নিন। অন্তত ডাবের জল নিন। নীতীশ বললেন, মাঝখানে উনি পরিশ্রম করে আর হাঁটাহাঁটি করে আরও রোগা হয়ে গিয়েছিলেন। এখন সেই তুলনায় ভালো। মমতা বললেন, রাহুলকে বরঞ্চ ডায়েট কোক দিন। ও ডায়েট কোক খায়। রাহুল জোরে হেসে উঠে বললেন, এখন ছেড়ে দিয়েছি।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। কিন্তু আবার নিছক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও নয়। দিল্লির বিধানসভা ভোটে কেজরীবালের কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল বিজেপি। কিন্তু বিহার ভোটের ফলাফলের পর যে গোটা দেশ জুড়েই বিজেপি বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে, তা নীতীশ নিজেই বলছেন। বিজেপি বিরোধী নেতাদের থেকেও তাই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের শেষ পর্যন্ত যে সমীকরণই তৈরি হোক না কেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে কাউকে অ-বিজেপি সরকার গঠনের ডাক দিতে হলে, তাঁর মমতাকে প্রয়োজন হতে পারে। মোদী বিরোধী মঞ্চে মমতাও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন। নীতীশ বলছেন, ‘‘আভি তো ইয়ে অঙ্গরাই হ্যায়, আগে অউর লড়াই হ্যায়।’’
মোদী বিরোধী সেই হাওয়াতেই নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গাঁধী, অরবিন্দ কেজরীবাল, সীতারাম ইয়েচুরিরাও পটনায় হাজির। এমন নয় যে এখনই সবাই মিলে কোনও ফ্রন্ট তৈরি করে ফেলছেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা উসকে দিচ্ছেন সকলেই। সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনের আগে মোদী সরকারের বিরোধিতায় নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ও বাড়াচ্ছেন।
আজ মমতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিহারের মহাজোটের পর এবার কি জাতীয় রাজনীতিতেও কোনও ফ্রন্ট তৈরি হতে চলেছে? মমতা জবাব দেন, মানুষের ফ্রন্ট তৈরি হচ্ছে। মমতা শিবিরের বক্তব্য, রাহুলের সঙ্গে আলাপচারিতা মানেই তো কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হচ্ছে, তা নয়। এ’টি ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়। রাজ্য রাজনীতির বিষয়টি সেখানে আলাদা
হোটেলের জানলা দিয়ে গতকাল রাতে গাঁধী ময়দানের আলোকিত প্রদর্শনী দেখছিলেন মমতা। কাছেই তো, হোটেল থেকে দূর নয়। এই সেই গাঁধী ময়দান যেখানে জয়প্রকাশ নারায়ণের ঐতিহাসিক ক্রান্তি র্যালি হয়েছিল।
মৌর্য হোটেলটাই এখন একটা চরিত্র! পাটলিপুত্র রাজনীতির স্নায়ুকেন্দ্র এখন এটাই। এখানেই সকালে মমতার সঙ্গে দেখা করলেন ডিএমকে সুপ্রিমো করুণানিধির পুত্র স্ট্যালিন ও দলের নেতা টিআর বালু। বেলা ১১টায় সেই বৈঠকের পরে দুপুর ১টায় এলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। তাঁদের বৈঠকে ফের এসে যোগ দিলেন স্ট্যালিন ও বালু।
এই হোটেলেই আছেন সীতারাম ইয়েচুরি। ফারুখ ও ওমর আবদুল্লা—পিতা-পুত্র, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়ার মতো নেতারাও এই হোটেলে। সকলেই গাড়ি করে গাঁধী ময়দানে গেলেন। কিন্তু একমাত্র মমতা ও কেজরীবাল হেঁটে পৌঁছলেন। হতচকিত হয়ে পড়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীও।
আজ পটনায় বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করে নানারকমের যে রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হল, তাতে একমাত্র অনুপস্থিত রইলেন মুলায়ম-অখিলেশ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু এসেছিলেন। বিহারের বিজেপি নেতা সুশীল মোদীও বাদ যাননি। দু’জনেই মনমরা ছিলেন। সীতারাম ইয়েচুরিও এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে অবশ্য মমতার কোনও কথা হয়নি। কিন্তু না এলে যে রাজনৈতিক ভাবে ভুল হত, তা বুঝেই ইয়েচুরি হাজির হয়েছিলেন। কেউ মজা করে বললেন, অনুপস্থিত তা হলে শুধু নরেন্দ্র মোদী ও মুলায়ম সিংহ যাদব।
কুয়াশার জন্য ঠিক সময়মতো বিমান নামতে না পারায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল রাহুলের। কিন্তু তিনি বিকেলে নীতীশের বাড়িতে চা-চক্রে যোগ দিতে ভুল করেননি। রাহুলের জন্য গোটা শহর জুড়ে কংগ্রেসের নেতারা তাঁর ছবি লাগিয়েছেন। বিহারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা সিপি জোশীও হাজির ছিলেন। এসেছিলেন লোকসভার কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেও। মমতা রাহুলকে দেখেই জানতে চান, দেরি হল কেন? রাহুল জানান, বিমান তাঁকে নিয়ে আকাশে চড়কি কাটছিল। মা আসেনি কেন, তা-ও জানতে চান মমতা। রাহুল অবশ্য উত্তর দেননি।
মমতাই নীতীশকে শপথগ্রহণের পর চা-চক্র আয়োজনের কথা বলেছিলেন। চা-চক্রের জন্য এক নম্বর অ্যানে মার্গে নীতীশের বাড়ির লন সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। ছিল আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবারই। লালু বললেন, এই বাড়ির তাঁর সবকিছুই চেনা। তিনি এখানে ১৫ বছর কাটিয়েছেন। চা-চক্রের পর নীতীশের বাড়ি থেকে ফের হেঁটে হেঁটেই দশ নম্বর সার্কুলার রোডে লালু-রাবড়ীর বাড়িতে চলে যান। সঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। লালু-রাবড়ী, লালুর দুই ছেলে তেজস্বী-তেজপ্রতাপ তো আছেনই। লালু-রাবড়ীর বাড়িতেও তাঁদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের মধ্যে মমতাকে নিয়ে হুল্লোড় চলল। মমতাকে মাঝখানে বসিয়ে সকলে ছবিও তুললেন।
কলকাতার পথে রওয়ানা হয়ে পটনা বিমানবন্দরে পৌঁছেও চমক। সিকিউরিটি চেকের পর বিমানবন্দরের টারম্যাকে হাঁটছিলেন মমতা। পাশেই একটি প্রাইভেট বিমান ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ ডাক এল, ‘মমতাজি, মমতাজি’। রাহুল বিমানের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মমতাকে দেখে ফের নেমে এসেছেন। জানালেন, তিনি দিল্লি রওয়ানা হচ্ছেন। তবে খুব শীঘ্রই ফের দেখা হবে।