রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কৃতী পড়ুয়ারা। — নিজস্ব চিত্র।
দুর্গা পুজোর বিসর্জনের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিল তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী অরুণিমা কুণ্ডু। জঙ্গলমহল এলাকার বলরামপুরে তার বাড়ি। আজ রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল গার্ডেনে ঘুরতে ঘুরতে এই তরুণীটি গায়ে চিমটি কেটে দেখেছে।
স্বপ্ন নয় তো!
দেশ জুড়ে ঊনত্রিশটি রাজ্যের প্রায় ৩০ লক্ষ ছাত্রছাত্রী অংশ গ্রহণ করেছিল ‘টাটা বিল্ডিং ইন্ডিয়া’র গদ্য রচনা প্রতিযোগিতায়। ১১টি ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজির এই রচনা যুদ্ধে শহরাঞ্চলের পাশাপাশি ছিল প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলপড়ুয়ারাও।
লেখার বিষয় ছিল, বর্তমান সময়ে ভারতের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী কী? পড়ুয়ারা প্রাণ খুলে লিখেছে। ত্রিস্তর পরীক্ষার পরে পুরস্কৃত হয়েছে মাত্র ৭২ জন। উৎকর্ষের বিচারে এই মুষ্টিমেয় সেরাদের মধ্যে যারা রয়েছে তাদের কেউ এসেছে জঙ্গলমহল থেকে, কারও বা ঠিকানা পশ্চিম মেদিনীপুরের কুকুরদহ। কারও বাবা বিশাখাপত্তনমের শপিং মলের দ্বাররক্ষী, আবার কেউ মুম্বইয়ের অটো চালক অথবা বেলগাঁও-এর ভাগচাষির ছেলে।
‘‘ভাবতে পারিনি আজ এখানে আসতে পারব’’, ফিকি অডিটোরিয়ামে পুরস্কার নিতে ওঠার আগে খুশি খুশি সুরে বলল অরুণিমা। সদ্য রাষ্ট্রপতি ভবনে ঘোরার পাশাপাশি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফটো সেশনও করেছে তারা।
এখন বলরামপুরের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরুলিয়ার জগন্নাথ কিশোর কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে প্রথম বর্ষে পড়ছে অরুণিমা। দু’চোখ ভর্তি স্বপ্ন, যা আজ নির্ঘাত হারিয়ে দিয়েছে বাল্যকালের আতঙ্ককে। অরুণিমার কথায়, ‘‘আমাদের ওখানে এখন সন্ধ্যার পর বিসর্জন বন্ধই হয়ে গিয়েছে। হিংসা আগের থেকে কমেছে ঠিকই, কিন্তু রাতবিরেতে কেউ বেশি ঝুঁকি নিতে চায় না।’’ সেই সময়ে ভাসানে তাদের লাইনেই দাঁড়ানো পাড়ার এক জনকে চোখের সামনে খতম করে পালিয়ে গিয়েছিল গিয়েছিল ‘কেউ’। সেই আতঙ্কের সাক্ষী অরুণিমা ভারতকে বদলে দিতে তার গদ্যে লিখেছে, দেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ভ্রূণ-হত্যা। তাকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
এ ভাবেই উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের দেবদূত রায় লিখেছে শিশু শ্রমিকের কথা। সালকিয়া হিন্দু স্কুলের সৌগত সরকার জানিয়েছে, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের পাশাপাশি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও পেশাদার দক্ষতার বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান বেলগাঁও-এর ভিরান গৌড়ার মতে সাম্প্রদায়িকতাকেই ভবিষ্যৎ ভারতের সবচেয়ে বড় কাঁটা। এদের কেউ হতে চায় অধ্যাপক, কেউ আইএএস, কেউ বা দক্ষ সমাজকর্মী।
‘‘গোড়ায় এই কর্মসূচি শুধুমাত্র শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল’’, জানাচ্ছেন প্রাক্তন কূটনীতিক রণেন সেন। আয়োজক সংস্থার পরিচালন পর্ষদের সদস্যও বটে। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৫- এ এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় ছোট আকারে। তখন শুধুমাত্র শহরাঞ্চলের ১ লাখ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বাছাই হতো। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামই পরামর্শ দেন, শহরে আটকে না রেখে একে ছড়িয়ে দেওয়া হোক গ্রাম গ্রামান্তরে।’’ সংস্থার কর্তারা জানাচ্ছেন এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর বাবা- মাকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। এক কর্তার কথায়, ‘‘এঁদের মধ্যে অনেকেই জানাচ্ছেন যে তাঁরা জীবনে প্রথম বিমান চোখে দেখলেন।’’ পুরস্কার হিসেবে পড়ুয়াদের দেওয়া হয়েছে ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরার মতো আধুনিক সরঞ্জাম।