পার্লামেন্টে হানার ছক হয়েছিল দীর্ঘ দিন ধরে। — ফাইল চিত্র।
বুধবার সংসদে হানার নেপথ্যে ছিল বিশাল পরিকল্পনা। প্রায় ১৮ মাস ধরে তৈরি হয়েছিল সেই ছক। দফায় দফায় বৈঠকে বসেছিলেন অভিযুক্তেরা। তদন্তে নেমে এমনটাই জেনেছে পুলিশ। তারা জানিয়েছে, অভিযুক্তেরা ভিন্রাজ্যের হলেও সমাজমাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। সমাজমাধ্যমে ‘ভগৎ সিংহ ফ্যান ক্লাব’ নামে একটি পেজ রয়েছে। সেখানেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন অভিযুক্তেরা। ভগৎ সিংহের মতো সংসদে প্যামফ্লেট ছড়ানোরও পরিকল্পনা ছিল তাঁদের।
দিল্লি পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অভিযুক্তেরা ১৮ মাস আগে মাইসুরুতে প্রথম বার বৈঠকে বসেছিলেন। ওই বৈঠকে তাঁরা বলেছিলেন, সংসদে ঠিক কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। তাঁরা মনে করতেন, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মণিপুরে হিংসা নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত। এর পর ন’মাস আগে, গত মার্চে দ্বিতীয় বার বৈঠকে বসেছিলেন অভিযুক্তেরা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, তখনই হামলার ছক কষা শুরু হয়েছিল। চণ্ডীগড় বিমানবন্দরের কাছে বৈঠকে বসেছিলেন তাঁরা। সে সময় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি)-র নিশ্চয়তা চেয়ে প্রতিবাদ করছিলেন কৃষকেরা।
পুলিশ জানিয়েছে, এর কয়েক মাস পরে বাজেট অধিবেশনের সময় সংসদে গিয়ে সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মনোরঞ্জন। সে সময়ই মনোরঞ্জন লক্ষ করেন, সংসদে প্রবেশের সময় দর্শকদের বার বার পরখ করছেন নিরাপত্তরক্ষীরা। কিন্তু তাঁদের জুতো পরীক্ষা করা হচ্ছে না। পুলিশ মনে করছে, তখন অভিযুক্তেরা পরিকল্পনা করেন যে, জুতোয় কিছু রেখে সংসদে প্রবেশ করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এর পর জুলাই মাসে লখনউয়ে গিয়েছিলেন সাগর। তিনিও তখন সংসদ চত্বরে একপ্রস্ত রেকি করে এসেছিলেন।
পুলিশ তদন্তে জানতে পেরেছে, অভিযুক্তেরা পুরনো সংসদ ভবনে গিয়েই বিষয়গুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সেপ্টেম্বরে নতুন সংসদ ভবনে অধিবেশন শুরু হয়। তার পর আর সেখানে ঢুকতে পারেননি অভিযুক্তেরা। তাঁরা বাইরে থেকেই চালিয়েছিলেন সমীক্ষা। নিরাপত্তার জন্য সেখানে কী ব্যবস্থা রয়েছে, সবই বোঝার চেষ্টা করেছিলেন বাইরে থেকে।
এর পর অভিযুক্তেরা স্থির করেন, সংসদে হামলার বর্ষপূর্তিতেই ফের হানা দেবেন সেখানে। সেই মতো রবিবার, ১০ ডিসেম্বর দিল্লি পৌঁছে গেছিলেন সাগর, মনোরঞ্জন, নীলম আজাদ, অমল শিণ্ডে। হরিয়ানায় ভিকি শর্মার বাড়িতে যান তাঁরা। বুধবার সকালে সংসদ ভবনের কাছে মহাদেব রোডে বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিংহের দফতর থেকে সংসদে প্রবেশের পাস সংগ্রহ করেন তাঁরা। প্রাথমিক ভাবে স্থির হয়েছিল, ছয় অভিযুক্তই ভিতরে যাবেন একসঙ্গে। কিন্তু সকলের জন্য পাস মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তাই দু’টি পাস নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন সাগর এবং মনোরঞ্জন। পাস জোগাড়ের পর ইন্ডিয়া গেটের কাছে জড়ো হয়েছিলেন অভিযুক্তেরা। সেখানে তাঁদের হাতে ‘রংবাজি’ দিয়েছিলেন শিণ্ডে। মহারাষ্ট্রের লাতুরে নিজের গ্রাম থেকে সেগুলি দিল্লিতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। ইন্ডিয়া গেটের ওই বৈঠক চলেছিল প্রায় আধ ঘণ্টা। পুলিশি তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, ভগৎ সিংহ ১৯২৯ সালে যা করেছিলেন, তেমন ভাবে সংসদে ‘রংবাজি’ ছোড়ার পর প্যামফ্লেট ছড়ানোরও পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারতীয় পতাকাও কিনেছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা রূপায়িত হয়নি।
বুধবার দুপুর ১টা নাগাদ লোকসভায় ‘জিরো আওয়ার’-এর সময় দর্শকদের গ্যালারি থেকে চেম্বারে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন সাগর এবং মনোরঞ্জন। জুতো থেকে হলুদ ধোঁয়া ভরা বোমা বার করে ছোড়েন তাঁরা। চারদিক হলুদ রঙের ধোঁয়ায় ভরে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সাংসদেরা। সাগর স্পিকারের চেয়ারের দিকে এগোতে থাকেন। তাঁকে ধরে ফেলেন দু’জন সাংসদ। সংসদের বাইরে সে সময় স্লোগান দিতে থাকেন নীলম, অমল। তারাও লাল, হলুদ ধোঁয়া ভরা বোমা ছোড়েন। এই ঘটনায় সাগর, মনোরঞ্জন ডি, অমল এবং নীলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাঁদের আর এক সহযোগী ভিকি শর্মাকে হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়। ললিত ঝায়েরও নাম জড়িয়েছে।