NCP Crisis

‘মহা-নাটক’ এ বার নির্বাচন কমিশনে, ৪০ বিধায়কের সমর্থন নিয়ে শরদকে ‘সরালেন’ অজিত

বান্দ্রায় অজিতের বৈঠক চলাকালীন মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে নরিম্যান পয়েন্টে তাঁর রাজনৈতিক গুরু প্রয়াত যশবন্ত রাও চহ্বাণের নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে অনুগামী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন শরদ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৩ ২৩:৫২
Share:

(বাঁ দিকে) শরদ পওয়ার এবং অজিত পওয়ার। —ফাইল চিত্র।

সকালে কাকার ছবি মঞ্চে রেখেই অনুগামী মন্ত্রী, বিধায়ক, নেতাদের নিয়ে বৈঠক শুরু করেছিলেন তিনি। বিকেলে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়েই কাকা শরদ পওয়ারকে সরিয়ে এনসিপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি পদে ‘নির্বাচিত’ হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন ভাইপো অজিত পওয়ার।

Advertisement

গত রবিবার অজিত-সহ ন’জন এনসিপি বিধায়ক মহারাষ্ট্রের শিন্ডেসেনা-বিজেপি জোট সরকারের মন্ত্রিপদে শপথ নিয়েছিলেন। বুধবার মুম্বইয়ের বান্দ্রায় এমইটি কলেজ অডিটোরিয়ামে অজিত বলেন, ‘‘সরকারে যোগ দেওয়ার দু’দিন আগেই এনসিপির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি আমি।’’ সেই সঙ্গে তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা, “আমি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হতে চাই।” তাঁর শিবিরের দাবি, বান্দ্রায় তাঁদের বৈঠকে দলের ৪০ জন বিধায়ক হাজির ছিলেন। দলত্যাগ-বিরোধী আইনের ‘খাঁড়া’ এড়াতে এনসিপির ৫৩ জন বিধায়কের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৬ জনের সমর্থন প্রয়োজন অজিতের। অর্থাৎ দাবি সত্যি হলে তাঁদের আশঙ্কার কথা নয়।

আত্মবিশ্বাসী অজিত কাকার উদ্দেশে বলেন, “মহারাষ্ট্র সরকারের কর্মীরা ৫৮ বছরে অবসর নেন। ৬০ বছর বয়স হলে আইপিস-আইএএসদের অবসর নিতে হয়। বিজেপিতেও ৭৫ বছরের বেশি বয়সে সক্রিয় রাজনীতি করা যায় না। লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর যোশীদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাহলে ৮২ বছর বয়সে আপনি (শরদ) কেন পদ আঁকড়ে আছেন? সরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সুযোগ করে দিন।” অজিতের মন্তব্যের কিছুক্ষণ পরেই শরদের মঞ্চ থেকে সুপ্রিয়া সুলের জবাব, “এখনও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের বয়স ৮২। তিনি কিন্তু অবসর নেননি, কাজ করে চলেছেন।”

Advertisement

বান্দ্রায় অজিতের বৈঠক চলাকালীন মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে নরিম্যান পয়েন্টে তাঁর রাজনৈতিক গুরু প্রয়াত যশবন্ত রাও চহ্বাণের নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে অনুগামী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন শরদ। মাত্র দু’মাস আগে, গত ২ মে এখানেই এনসিপির বৈঠকে নাটকীয় ভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা করেছিলেন তিনি। সে দিন দলের সাংসদ, বিধায়ক, পদাধিকারীরা একযোগে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য শরদ পওয়ারের কাছে অনুনয়-বিনয় শুরু করেছিলেন। কিন্তু বুধবার তাঁর ম়ঞ্চে দেখা গেল এনসিপির মাত্র ১৩ বিধায়ককে।

তবে দলের লোকসভা-রাজ্যসভা সাংসদদের অধিকাংশ এখনও রয়েছেন ৮২ বছরের মরাঠা নেতার পাশে। অনুগামী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নতুন ‘লড়াই’ শুরু করার কথা ঘোষণা করে শরদ বলেছেন, ‘‘আমাদের হাত থেকে এনসিপির প্রতীক কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’’ শরদের এই ঘোষণার নেপথ্যে রয়েছে অজিত শিবিরের অন্য একটি পদক্ষেপ। এনসিপি নাম এবং নির্বাচনী প্রতীক ‘ঘড়ি’ চেয়ে বুধবার দুপুরেই নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে অজিত শিবির।

পরিস্থিতি বদল দু’মাসেই

দু’মাসেই বদলে গেল পরিস্থিতি। গত ২ মে মুম্বইয়ের নরিম্যান পয়েন্টের যশবন্ত রাও চহ্বাণ সেন্টারেই এনসিপির বৈঠকে নাটকীয় ভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা করেছিলেন তিনি। সে দিন দলের সাংসদ, বিধায়ক, পদাধিকারীরা একযোগে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য শরদ পওয়ারের কাছে অনুনয় শুরু করেছিলেন। বুধবার সেই নেতাদেরই একাংশ ১৮ কিলোমিটার দূরে বান্দ্রার এমইটি কলেজ অডিটোরিয়ামে সম্মেলন করে শরদকে দলের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে ভাইপো অজিতকে বসানোর কথা ঘোষণা করলেন। ঘটনাচক্রে, অজিত শিবিরের নেতা ছগন ভুজবল, প্রফুল্ল পটেল, দিলীপ পাতিল, সুনীল তটকরেদের ওই ঘোষণার সময় শরদ ছিলেন সেই যশবন্ত রাও চহ্বাণ সেন্টারেই।

স্ট্যাম্প পেপারে বাধ্যতামূলক সই

নরিম্যান পয়েন্টে শরদের বৈঠক শুরুর ঘণ্টাখানেক পরেই শুরু হয়েছিল অজিত শিবিরের সম্মেলন। সেখানে হাজির বিধায়কদের রীতিমতো ১০০ টাকার ‘স্ট্যাম্প পেপার’-এর হলফনামায় সই করিয়ে সমর্থনের অঙ্গীকার করতে হচ্ছিল। সই নেওয়া হয় দলের সাংসদ, বিধান পরিষদ সদস্য মায় সর্বভারতীয় থেকে জেলা স্তরের প্রতিনিধিদেরও। দুপুর পৌনে ১টা নাগাদ সম্মেলনের মঞ্চে আরও কিছু বিধায়ককে নিয়ে পৌঁছন অজিত। তার পরেই সমর্থনকারী জনপ্রতিনিধি এবং নেতাদের তালিকা তাঁকে দেওয়া হয়। শরদ শিবিরের বৈঠকেও বিধায়কদের স্ট্যাম্প পেপারে সই করিয়ে সমর্থনের হলফনামা দিতে হয়।

‘হাজির’ শরদ, ‘গরহাজির’ সুপ্রিয়া

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যুযুধান দুই গোষ্ঠীর অধিবেশনের মঞ্চেই ‘হাজির’ ছিলেন শরদ পওয়ার— ছবিতে এবং স্লোগানে। যশবন্ত রাও চহ্বাণ সেন্টারের মঞ্চে ছিল একমাত্র তাঁরই ছবি। অন্য দিকে, অজিত গোষ্ঠীর মঞ্চেও সবচেয়ে বড় ছবি ছিল শরদেরই। তার পর অপেক্ষাকৃত ছোট অবয়বে অজিত, প্রফুল্ল পটেল, ছগন ভুজবল এবং সুনীল তটকরে। অজিত শিবিরের অন্য মন্ত্রী এবং কয়েক জন বিধায়কের সারিবদ্ধ মুখের ছবিও দেখা গিয়েছে মঞ্চে।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কোনও মঞ্চেই ছিল না শরদ-কন্যা সুপ্রিয়া সুলের ছবি! গত ২৮ জুন মুম্বইয়ে এনসিপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের মঞ্চে শরদের পাশাপাশি, দলের দুই সদ্য নিযুক্ত কার্যনির্বাহী সভাপতি সুপ্রিয়া এবং প্রফুল্লের ছবি ছিল। কিন্তু বাদ পড়েছিলেন অজিত। গত সপ্তাহের ওই ঘটনাই এনসিপি এবং পওয়ার পরিবারের অন্দরের ফাটল আরও চওড়া করে বলে দলের একটি সূত্রের খবর। বারামতীর সাংসদ সুপ্রিয়াকে অবশ্য বুধবার শরদ-গোষ্ঠীর বৈঠকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। সেই সঙ্গে শরদের নাতি তথা এনসিপি বিধায়ক রোহিত পওয়ারকেও দেখা গিয়েছে আয়োজকের ভূমিকায়।

ভুজবলের ‘গুরুদক্ষিণা’, রাজের ‘নাটক’

বান্দ্রার সম্মেলনের শুরুতে শরদের নামে জয়ধ্বনি করে মন্ত্রী ছগন বলেন, ‘‘শরদজি আমাদের গুরু। তাই আমরা গুরুদক্ষিণা দিয়েছি। ওঁর ভাইপোকে উপমুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছি।’’ তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শরদকে সরিয়ে অজিতকে সর্বসম্মত ভাবে দলের সভাপতি মনোনীত করলেন ভুজবল, প্রফুল্ল, সুনীল, দিলীপরা। অন্য দিকে, মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) প্রধান রাজ ঠাকরে মঙ্গলবার এনসিপির ভাঙন সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আমাদের কাছে খবর রয়েছে, পুরোটাই শরদ পওয়ারের নাটক।’’

শিবির বদলের উলটপুরাণ

গত দু’দিন ধরেই শরদ গোষ্ঠী অভিযোগ তুলেছে, ইডি-সিবিআইয়ের ভয় দেখিয়ে বিধায়কদের বন্দি বানিয়েছে অজিত শিবির। ঘটনাচক্রে, মঙ্গলবার রাতে অজিতকে ছেড়ে শরদ শিবিরে ফিরে আসা দুই এনসিপি বিধায়ক কিরেন লহমাটে এবং অশোক পওয়ারও বুধবার ‘চাপ তৈরির’ অভিযোগ তুলেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে। তাঁদের দাবি, আরও বেশ কয়েক জন বিধায়ক শরদের শিবিরে ফিরে আসতে চান। অজিত শিবিরের পাল্টা দাবি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই শরদ গোষ্ঠীর আরও কিছু বিধায়ক শিবির বদল করবেন।

‘ঘড়ি’ নিয়ে কাড়াকাড়ি

মঙ্গলবার এনসিপির পতাকা এবং নির্বাচনী প্রতীক ‘ঘড়ি’-র অধিকার দাবি করে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছে অজিত গোষ্ঠী। ভাইপোর এমন পদক্ষেপের সম্ভাবনা আগেই আঁচ করেছিলেন কুশলী মরাঠা রাজনীতিক শরদ। মঙ্গলবার সকালেই নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি হলফনামা দিয়ে ক্যাভিয়েট দাখিল করেছে তাঁর শিবির। তাঁদের না জানিয়ে অজিত গোষ্ঠীকে যাতে একতরফা ভাবে এনসিপির নির্বাচনী প্রতীক ‘ঘড়ি’ দেওয়া না হয়, সে জন্যই কমিশনে হলফনামা দেওয়া হয়। কোনও রাজনৈতিক দলে ভাঙনের সময় দলের পতাকা এবং নির্বাচনী প্রতীক বণ্টনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কার্যত ‘বিচারবিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল’-এর ভূমিকা পালন করে। যুযুধান দুই গোষ্ঠীর সমর্থক বিধায়ক, সাংসদ-সহ বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি এবং সাংগঠনিক পদাধিকারীদের তালিকা পরীক্ষা করে কয়েক দফার শুনানির পর সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে কমিশন। কোনও গোষ্ঠীর গরিষ্ঠতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলে তাদের নাম এবং প্রতীক ব্যবহারের অধিকার দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। সাম্প্রতিক কালে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার ভাঙনের সময় উদ্ধব ঠাকরের আপত্তি উড়িয়ে একনাথ শিন্ডের গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কমিশন। তামিলনাড়ুতে এডিএমকের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর গোষ্ঠী লড়াইয়ের সময়ও পনীরসেলভম গোষ্ঠীর দাবি খারিজ করে পলানীস্বামী গোষ্ঠীকে পতাকা এবং প্রতীক ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়েছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement