গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচির মঞ্চ থেকে যে মঙ্গলবার তিনি বিরোধীদের খোঁচা দেবেন তা প্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবেও তার ব্যতিক্রম হল না। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ১৫ অগস্টের বক্তৃতা শুনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেস নেতৃত্ব নন, তাঁর মূল নিশানা ছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা সোমবার জানিয়েছিলেন ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হবে। তিনি বলেন, ‘‘প্রার্থনা করি, লালকেল্লায় শ্রদ্ধেয় মোদীবাবুর (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) যেন শেষ ভাষণ হয়! আগামী বছর ইন্ডিয়া পতাকা তুলবে।’’ মঙ্গলবার সকালে ভারতের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লালকেল্লার বক্তৃতায় মোদী বার্তা দিলেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গড়বে বিজেপিই। ভারতবাসীকে নিজের পরিবার হিসাবে সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘‘যে সব প্রকল্পের শিলান্যাস আমি করেছি, তার উদ্বোধনও আমার ভাগ্যে লেখা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’
পরের বছর তিনি আবার লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলন করতে আসবেন বলেও মঙ্গলবার মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ, কেন্দ্রে বিজেপিই যে আবার সরকার গড়বে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে বসবেন, নিজের মন্তব্যের মাধ্যমে কৌশলে সেই বার্তাই দেন মোদী। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার মঞ্চ থেকে ধারাবাহিক ভাবে সরকারি নীতির ঘোষণা এবং বিরোধী পক্ষকে নিশানা করতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে। মনে করা হয়েছিল, ১৫ অগস্টের বক্তৃতায় চলতি বছরে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট এবং আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনী প্রচারের শিঙা ফুঁকতে চলেছেন তিনি। কার্যক্ষেত্রে হয়েছেও তা-ই। এক দিকে, কংগ্রেসের ইতিহাস এবং পূর্বতন শাসনকে আক্রমণ করেছেন মোদী। অন্য দিকে, তাঁর সরকারের গত ন’বছরের বিভিন্ন প্রকল্প ধরে ‘ব্যাখ্যা’ দিয়েছেন সাধারণ এবং গরিব মানুষের জীবন এই যোজনাগুলির কল্যাণে কী ভাবে বদলে গিয়েছে।
লালকেল্লার ভাষণে আগের কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতার তুলনায় গত ১০ বছরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাফল্য-কাহিনি বেশি শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। যার অনেকটা জুড়েই ছিল করোনা আবহে টিকাকরণ নিয়ে কেন্দ্রের ভূমিকা এবং অর্থনীতি। মোদী বলেন, ‘‘করোনার সময় ভারত যে ভাবে কাজ করেছে, তা সারা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ২০০ কোটি টিকাকরণের কথা শুনে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে গিয়েছে। আমাদের আশাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকাকরণ করিয়েছেন। সরকারের লক্ষ্যপূরণে সরকারি কর্মীরা সাহায্য করেছিলেন।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘১০ বছর আগে বিজেপি সরকার গঠনের আগে ভারতের অর্থনীতির হাল খারাপ ছিল। কিন্তু গত দশ বছরে বর্তমান সরকারের চেষ্টায় বিশ্ব দরবারে ভারত পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। খুব শীঘ্রই তা তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে।’’
পরের বার ‘ইন্ডিয়া’, দাবি মমতা
স্বাধীনতা দিবসের আগে কলকাতার বেহালার দলীয় একটি কর্মসূচি থেকে মমতা রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা আর কেন্দ্রীয় সংস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বুলডোজ়ার দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা লুট করে নিয়েছে। আমরা এখন বিজেপির শাসনে আছি। আমরা স্বাধীন নই। আমরা পরাধীন!’’ মণিপুর ও কাশ্মীরের নাম করে তিনি বলেন, ‘‘মণিপুরের মানুষ কি স্বাধীন? মণিপুরে গির্জা, মন্দির জ্বালিয়ে দিয়েছে। মণিপুর, হরিয়ানা, কাশ্মীর যদি কাঁদে, তা হলে আমরা স্বাধীন দেশের জন্য কী গর্ব করব? আমরা কি বলব স্বাধীনতা আছে? গান্ধীজির কথা বলে না। গান্ধীর হত্যাকারীর কথা বলে।’’ পাশাপাশি, পরের বার ‘ইন্ডিয়া’ কেন্দ্রে সরকার গড়বে দাবি জানিয়ে তিনি শ্রোতাদের উদ্দেশে আবেদনে বলেন, ‘‘এ রাজ্যে জোট বেঁধে এক একটা ভোট তৃণমূল কংগ্রেসকে দিন। অন্য রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’র অন্য শরিকদের।” বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘চালন (চালুনি) সুচের দোষ ধরছে! বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই লাগিয়ে দিয়েছে। এখন তো ওয়াশিং পাউডার ভাজপা এসেছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘বাংলা দুর্নীতি করে না। সরকারের হাতে দু’একটা কেস ভুল হতে পারে। মায়ের হাতের রান্নাতেও এক দিন নুন বেশি হয়ে যায়!’’ তার পরেই নোটবন্দি, পিএম কেয়ার তহবিলের কথা টেনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘তোমরা কত করেছ?’’
‘পরিবারজন’ বলে হোঁচট মোদীর
মঙ্গলবার লালকেল্লার বক্তৃতায় দেশবাসীকে নতুন সম্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এত দিন বলে এসেছেন ‘মেরে পেয়ারে দেশবাসীও’ অর্থাৎ ‘আমার আদরের দেশবাসী’। মঙ্গলবার সেই দেশবাসীকে ‘পরিবারজন’, অর্থাৎ পরিবারের সদস্য বলে অভিহিত করলেন মোদী। যদিও বিরোধীরা বলছেন, দেশবাসীর সঙ্গে এই হঠাৎ ‘ঘনিষ্ঠতার’ কারণ আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। এক সময় দেশবাসীর উদ্দেশে মোদী তাঁর বক্তৃতা শুরু করতেন ‘মিত্রোঁ’ অর্থাৎ ‘বন্ধু’ সম্বোধনে। ওটাই ছিল তাঁর ‘সিগনেচার’। ২০১৪ সালের পর ২০১৯-এ ক্ষমতায় আসার পর মোদীর সম্বোধনে যোগ হয় নতুন কয়েকটি বিকল্প। বহু জনসভায় মোদী উপস্থিত জনগণকে ‘ভাইয়ো অর বেহনোঁ’ বলে সম্বোধন করেছেন। আবার স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চে তাঁকে ‘আদরের দেশবাসী’ বলতেও শোনা গিয়েছে গত বেশ কয়েক বছরে। মঙ্গলবার সেই চেনা লব্জের বদল তাই অনেকেরই কানে লেগেছে। একই সঙ্গে চোখে পড়েছে এই বদলের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত মোদীর তাল রাখতে না পারাও। মঙ্গলবার মোদী তাঁর বক্তৃতার প্রথম ৪০ মিনিটের প্রতিটি বাক্যের শুরুতে দেশবাসীকে সম্বোধন করেছেন ‘‘আমার আদরের পরিবারের সদস্য’’ বলে। কিন্তু দেড় ঘণ্টার বক্তৃতার শেষের দিকে বেশ কয়েক বার সম্বোধন বদলেও যায়। মোদী তাঁর পুরনো ডাক ‘প্রিয় দেশবাসী’তে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে সম্বোধনের ভাষায় দু’-এক বার বদল অস্বাভাবিক নয় বলেই মত মোদীপন্থীদের। যদিও বিরোধীরা বলেছেন, আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর এই বচন বদলও আসলে এক অন্য রকম প্রচার।
খড়্গের খোঁচা মোদীকে
পরের ১৫ অগস্টের পতাকা উত্তোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে মমতা কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী পরের বছর ১৫ অগস্ট জাতীয় পতাকা তুলতেই পারেন। তবে সেই পতাকা তাঁকে তুলতে হবে নিজের বাড়িতে।’’ অর্থাৎ মমতার সুরেই খড়্গে বার্তা দেন, আগামী লোকসভা ভোটে ক্ষমতায় আসতে চলেছে ‘ইন্ডিয়া’। মঙ্গলবার লালকেল্লায় সরকারি কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী আক্রমণ করেছিলেন কংগ্রেসকে। সেখানে আমন্ত্রণ থাকলেও যাননি খড়্গে। পরে কংগ্রেসের কর্মসূচিতে জওহরলাল নেহরু থেকে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত অতীতের প্রধানমন্ত্রীদের নানা উন্নয়ন কর্মসূচির খতিয়ান তুলে ধরে মোদীকে খোঁচা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ধারণা, দেশে যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ শুধু গত কয়েক বছরেই হয়েছে।’’ দেশ গঠনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের অবদানকে মোদী স্বীকৃতি দেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সংসদে বিরোধীদের মাইক্রোফোন বন্ধ করে তাঁদের বলতে না দেওয়ার যে অভিযোগ রাহুল গান্ধী ব্রিটেনে গিয়ে তুলেছিলেন, মঙ্গলবার স্বাধীনতা দিবসে সেই অভিযোগও তোলেন কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা খড়্গে। মঙ্গলবার দিল্লিতে কংগ্রেস সদর দফতরে স্বাধীনতার ৭৭তম কর্মসূচিতে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে নিশানা করে তিনি বলেন, ‘‘বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। বিরোধী সাংসদদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। রাজ্যসভায় আমার মাইক্রোফোনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’’