মোদীর সফরের আগে পোস্টার আঁকছেন প্রবাসী বাঙালিরা। - নিজস্ব চিত্র।
অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে যতই উৎসবের আবহ তৈরি হোক না কেন, তাঁর দ্বিতীয় মার্কিন সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে চলেছেন বলে মনে করছে কূটনৈতিক শিবির। মোদী সফরের প্রাক্কালে এ ব্যাপারে একটি মার্কিন সরকারি থিংক ট্যাঙ্কের রিপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্তাদের মন্তব্য এই ইঙ্গিতই করছে।
চলতি বছরের গোড়ায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন নয়াদিল্লি সফরে এসেছিলেন, তখন তাঁকে ‘বারাক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন মোদী। দু’জনে মিলে ‘চায়ে পে চর্চা’ করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, অবসর সময়ে তিনি এবং ওবামা হাসি-ঠাট্টাও করে থাকেন।
বছর ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। আগামী বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনিই নির্বাচিত হোন, আপাতত প্রধানমন্ত্রীকে যে মার্কিন নেতৃত্ব ও বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নবাণের সামনে পড়তে হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত সাউথ ব্লক। গত এক বছরে আমেরিকার সংস্থাগুলোর বিনিয়োগের পথ মসৃণ করতে ভারত কী করেছে, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রাক্কালে এ ব্যাপারে বেসুরে গেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন আমলা নিশা দেশাই বিসওয়াইল। দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই সহ-সচিবের কথায়, ‘‘দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ভারতকে প্রথমেই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী এবং বিশ্ববাজারকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তারা নিজেদের দরজা খুলে রেখেছে।’’ কী ভাবে এই কাজ করতে পারে ভারত, তার ইঙ্গিতও দিয়েছেন নিশা। তিনি বলেছেন, ‘‘ভারত যদি তার করবিধিকে কিছুটা সরল করে তা হলে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের রাস্তা অনেকটাই মসৃণ হয়ে যাবে। এতে ভারতের নাগরিকরাও অনেকটা সুবিধা পাবেন, আবার আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের অর্থনৈতিক মর্যাদাও বাড়বে।’’
এটা ঘটনা যে, আমেরিকা সফরে যাওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর পকেটে এমন কিছু নেই যা খুশি করতে পারে আমেরিকাকে। শিল্প ও বাণিজ্যের সহায়ক পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাঙ্কের সদ্য প্রকাশিত একটি সমীক্ষা তালিকায় ভারতের স্থান ১৪২ নম্বরে। নিঃসন্দেহে, এটা ভারতের ভাবমূর্তির প্রশ্নে একটা বড় ধাক্কা। দেড় বছর হয়ে গেল ক্ষমতায় এসেছেন মোদী, কিন্তু আমেরিকা-সহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের প্রার্থিত আর্থিক সংস্কার এখনও করে উঠতে পারেননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক বিরোধিতার জেরে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) বিলটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিজেপির দাবি, কংগ্রেস মোদী সরকারকে সব দিক থেকে হেয় করার জন্য আর্থিক সংস্কারের পথ আটকাতে চাইছে। কিন্তু অধৈর্য মার্কিন কর্তারা সে সব শুনতে নারাজ। মার্কিন কর্তাদের বক্তব্য, অভিন্ন করনীতি চালু হলে পণ্য চলাচলের ক্ষেত্রে অদৃশ্য বাধা দূর হয়ে যাবে। মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, যে সব ক্ষেত্রে শম্বুকগতিতে হলেও বাজার খুলছে ভারত, সেখানেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। যেমন খাতায় কলমে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো পণ্যে ৫১ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ খোলা হয়েছে। কিন্তু বিদেশি সংস্থাগুলোকে দেশে নিয়ে আসার জন্য হাতে কলমে কোনও পদক্ষেপই করেনি নয়াদিল্লি।
প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফরের আগে সেখানকার এক সরকারি থিংক ট্যাঙ্ক ‘পিটারসন ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক্স’ একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। যার নাম, ‘ইন্ডিয়াজ রাইজ— আ স্ট্র্যাটেজি ফর ট্রেড লেড গ্রোথ’। সেখানে বলা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে বাণিজ্যিক উদারিকরণ করা হলে ভারতের বার্ষিক বৃদ্ধি বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নেটওয়ার্ক-এর বাইরে থাকলে ভারতকে যে অন্ততপক্ষে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি খোয়াতে হবে, রিপোর্টে বলা হয়েছে এমন কথাও।
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, ২৮ তারিখ নিউ ইয়র্কের বৈঠকে ওবামাকে মোদী এ কথাই বোঝাবেন যে, শক্তিশালী গণতন্ত্র রয়েছে এমন কোনও দেশে বড় ধরনের সংস্কার আনতে সময় লাগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন সরকার আসার পর বিনিয়োগ টানার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো মার্কিন কর্তাদের সামনে তুলে ধরা হবে। পুরনো বাণিজ্য চুক্তির উপর নতুন করে কর বসানো নিয়ে পশ্চিমের সংস্থাগুলোর মধ্যে যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল, তা লাঘব করতে পেরেছেন মোদী। যে কোনও মূলধনী লাভের উপর ম্যাট (মিনিমাম অল্টারনেটিভ ট্যাক্স) রদ করেছে মোদী সরকার। কিন্তু এখনও যে চলার জন্য অনেকটা পথ বাকি সেটা স্বীকার করছে সাউথ ব্লক।
মোদী-ওবামা বৈঠকের আগে কাল বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আলোচনায় বসবেন মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী মাইকেল ফ্রোমানের সঙ্গে। গত জানুয়ারি মাসে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে চুক্তি হয় অজমের, ইলাহাবাদ এবং বিশাখাপত্তনমকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলার। তিন মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত পথ নির্দেশিকা তৈরি করা হবে বলেও জানানো হয়েছিল সেই সময়। কিন্তু বাস্তবে এ ব্যাপারে কোনও অগ্রগতি হয়নি। আসন্ন বৈঠকে এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের আশু সহযোগিতা চাইবে নয়াদিল্লি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের ঠিক মুখেই অবশ্য মার্কিন সংস্থা বোয়িং-এর কাছ থেকে হেলিকপ্টার কিনতে ২৫০ কোটি ডলারের চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি। মঙ্গলবার এই চুক্তির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি। আবার ভারত-মার্কিন কৌশলগত আলোচনার শেষে আজ মুম্বই হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে একযোগে পাকিস্তানের উদ্দেশে বিবৃতিও জারি করেছে দু’দেশ। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরির এই বৈঠকের পরে যৌথ বিবৃতিতে দু’দেশ জানিয়েছে, লস্কর, আল-কায়দা, ডি-কোম্পানির মতো সংগঠন দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে।
নিউ ইয়র্কে সনিয়া-রাহুলও
মোদী যখন রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে থাকবেন, একই সময়ে ওই শহরে যাচ্ছেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। সঙ্গে প্রিয়ঙ্কাও। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়েই সনিয়া-রাহুলের নিউ ইয়র্কে যাওয়া নিয়ে এ দিন রাজনীতিকদের মধ্যে কিঞ্চিত জল্পনা হয়। তবে কংগ্রেসের তরফে এক বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকা যাচ্ছেন রাহুল। তা ছাড়া সূত্রের খবর, এ বার সনিয়ার চিকিৎসার জন্যই গাঁধীরা সপরিবার নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। কারণ সেখানেই কংগ্রেস সভানেত্রীর চিকিৎসা হয়। নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার জন্যও যেতে হয় তাঁকে।