বিরল বিরোধী ঐক্য। নোট বাতিলে মানুষের হয়রানির প্রতিবাদে সংসদ চত্বরে একজোট কংগ্রেস-তৃণমূল-বামেরা। বুধবার প্রেম সিংহের তোলা ছবি।
সমাজবাদী পার্টির পাশে বহুজন সমাজ পার্টি! ডিএমএকে-র পাশে এডিএমকে! তৃণমূলের সঙ্গে এক সারিতে সিপিএম!
রাজনৈতিক মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে বিরোধী দলগুলিকে এ ভাবে একজোট হতে হাতে গোনা কয়েক বারই দেখেছে রাজধানী। শেষ বার দেখেছে বফর্স কাণ্ডে। তারও আগে এক বার জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে। দু’বারই বিরোধীরা এক মঞ্চে জড়ো হয়েছিলেন কংগ্রেস-বিরোধিতার প্রশ্নে। আর আজ পাশা পাল্টে তৃতীয় বার বিরোধী দলের মহাসম্মেলনে কেন্দ্রীয় চরিত্রই কংগ্রেস তথা দলের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। নিশানায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, ডিএমকে, এডিএমকে-সহ ১৫টি বিরোধী দলের প্রায় আড়াইশো সাংসদ এ দিন সকাল দশটায় সংসদ চত্বরে গাঁধীমূর্তির সামনে গলা চড়ালেন নোট-বাতিলের জেরে মানুষের হেনস্থা নিয়ে। হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে গড়লেন প্রতীকী মানব-শৃঙ্খল। শুধু দাঁড়ালেনই না, অভিনব কায়দায় সাংসদদের সেই লম্বা লাইনটি এগোতে শুরু করল! মূল ফটক দিয়ে সেই লাইন ঢুকে গেল সংসদের ভিতরে!
সকালের ধর্নার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, আজ সংসদের দু’টি কক্ষই বারবার মুলতুবি হয় যৌথ বিরোধিতায়। গত কালের মতোই ওয়েলে নেমে স্লোগান দেন বিরোধীরা। মূল দাবি, সংসদের অন্য কাজ মুলতুবি রেখে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে সেই আলোচনায় অংশ নিতে হবে। জট না-খোলায় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অনন্তকুমার জানান, আগামিকাল লোকসভা ও রাজ্যসভার কিছু বিরোধী দলনেতার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। বৈঠকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ করা হয় কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদ, তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, ডিএমকে-র ডি বেনুগোপালের মতো নেতাদের। বাছাই করা নেতাদের ডেকে বিরোধী ঐক্য ভেস্তে দেওয়ার যে কৌশল বিজেপি নিয়েছিল, তা সফল হতে দেয়নি কংগ্রেস। সব দলকে কেন ডাকা হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তোলেন গুলাম নবি আজাদ। তার পর বাকিরাও জানিয়ে দেন, ওই বৈঠকে তাঁরা যাচ্ছেন না।
মোদীর জমানায় বিরোধীরা জোটবদ্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছেন আগেও। ২০১৫-তে জমি অধিগ্রহণ বিলের প্রতিবাদে সনিয়া গাঁধীর ডাকে বিরোধী সাংসদরা দলবদ্ধ ভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে সাংসদেরা এত বিপুল সংখ্যায় হাজির ছিলেন না। জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে প্রতিটি দলের অন্দরেই ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল। ফলে সেই মিছিলে আজকের মতো আবেগও ছিল না, যার জোরে রাজ্য-রাজনীতিতে সাপে-নেউলের সম্পর্ক ভুলে সব দল এক ছাতার তলায় আসতে পারে। এ দিনের প্রতিবাদে কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই যোগ দেন জয়ললিতার এডিএমকে-র সাংসদরা। যাঁরা ডিএমকে-র পাশে দাঁড়িয়ে মুখর হলেন সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহির দাবিতে। ঠিক যে ভাবে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি, তৃণমূল এবং সিপিএম নেতারা এ দিন স্লোগানে উত্তাল হলেন, ‘কিসান মজদুর ভুখা হ্যায়/ মোদী সরকার ঝুটা হ্যায়।’
এই জোটবদ্ধ প্রতিবাদে সমানে উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছেন রাহুল। এ দিনের প্রতিবাদের সাফল্য মোদীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁকে ও তাঁর দলকে অনেকটাই অক্সিজেন জোগাবে। তবে রাজনীতির জগতের লোকজন মনে করছেন, গোটা বিরোধী শিবিরকে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার এই যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া— তার নেপথ্যে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি সফল ভাবে রাহুল গাঁধী ও অন্য বিরোধী দলগুলিকে এই বার্তাটি দিতে পেরেছেন যে, এটা মানুষের হয়রানির প্রতিবাদ। কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা নেতার নয়। মমতা কংগ্রেস-সহ প্রতিটি দলকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক পরিসরটি ছেড়ে দেওয়াতেই মসৃণ হয়েছে ঐক্যের পথ। শেষ মুহূর্তে এডিএমকে-কে পাশে পাওয়াই এ দিনের বড় চমক। তৃণমূলের বক্তব্য, এ-ও সম্ভব হয়েছে মমতারই দৌত্যে। তৃণমূল নেতাদের দাবি, আজ যে মানবশৃঙ্খল হয়েছে, সেটাও মমতার মস্তিষ্কপ্রসূত। গত কাল রাতে দিল্লিতে পৌঁছে মমতা এই প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি জানানো হয় রাহুলকে। তিনিও দ্বিধা করেননি তাতে সায় দিতে।
আজ আগাগোড়া রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে তৃণমূলের সুদীপকে। বারবারই কথা বলেছেন দু’জনে। সেই সূত্রেই সুদীপ পরে জানান, ‘‘রাহুল আজকের এই সাফল্যে এতটাই খুশি যে আমাকে বললেন, এ ভাবেই যদি হাতে হাত ধরে সারিবদ্ধ ভাবে এখনই রাষ্ট্রপতিভবনে চলে যাওয়া যায়, তা হলে কেমন হয়! আমি তাঁকে বলেছি, আমরা তো সব সময়ই রাষ্ট্রপতির কাছে মানুষের এই চরম দুর্দশা নিয়ে দরবার করার পক্ষে।’’
নোট বাতিলের ঘোষণার পরই মমতা তড়িঘড়ি যখন রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলিকে আহ্বান জানান, তখনও যথেষ্ট দোলাচলে ছিলেন বিরোধীরা। ক্রমে মানুষের দুর্গতি বাড়তে দেখে এবং একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন বিরোধীরা। স্থির হয়েছে, আগামিকাল বিরোধী দলগুলির বৈঠকের পরই রাষ্ট্রপতিভবনে যাওয়ার জন্য সময় চাওয়া হবে। কংগ্রেস পরশু সাক্ষাতের সময় চাইতে পারে। বাকি সব বিরোধী দল রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে আগ্রহী হলেও দিনের শেষে অবশ্য কিছুটা বেসুর শোনা গিয়েছে মুলায়ম সিংহের দলের নেতাদের মুখে।
নোট কাহিনি
• এত দিন ৩০টি বড় শহরে বেশি টাকা পাঠিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক
• এ বার বেশি টাকা পাবে গ্রামীণ এলাকা
• বুধবার রাত পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ৩০ শতাংশ এটিএম-কে নতুন টাকার উপযোগী করে তোলা গিয়েছে
• নোটের আকালে চা-বাগান, চটকল, বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি দিতে সমস্যা
• আলু-পেঁয়াজের জোগানে টান পড়ার আশঙ্কা
• রবি চাষে ঋণের পথ প্রশস্ত করতে ৩০০ কোটি চাইল জেলা সমবায় ব্যাঙ্কগুলি
• প্রয়োজনে ধারে সার দেওয়ার পরামর্শ
• সব রাষ্ট্রায়ত্ত ও কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ড ব্যবহারে চার্জ মকুব ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত
• ই-ওয়ালেটে লেনদেনের সীমা বেড়ে মাসে ২০ হাজার n অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটলে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত লাগবে না সার্ভিস চার্জ