সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম অর্ধ শেষ হতে আর পাঁচ দিন বাকি। তার মধ্যে সাধারণ ও রেল বাজেট পাশ করাতে হবে। সেই সঙ্গে খনি, কয়লা খনি বণ্টন ও জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশের বিল পাশ করানোর লক্ষ্য নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। কিন্তু আগামী সপ্তাহের গোটাটাই সংসদের অধিবেশন পণ্ড করে দিতে বিষয়ের ‘রামধনু’ সাজিয়েছে কংগ্রেস! মূল লক্ষ্য, ওই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও প্রধানমন্ত্রীর জবাব দাবি করে সভা কার্যত অচল করে রাখা। যাতে সাধারণ বাজেট ও রেল বাজেট ছাড়া আর কোনও বিলই পাশ না হয়।
কী কী সেই বিষয়?
এক, জমি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি। দুই, রাহুল গাঁধীর বাড়িতে পুলিশি ‘চরবৃত্তির’ অভিযোগ। তিন, জম্মু-কাশ্মীরের বিজেপি-পিডিপি জোট সরকার মাসারাত আলমকে মুক্তি দেওয়ার পরে কাশ্মীর নিয়ে ওই বিচ্ছিন্নতাকামী হুরিয়ত নেতার বিতর্কিত মন্তব্য। চার, পঞ্জাবে নানকশাহী ক্যালেন্ডারে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যাকারীদের জন্মদিন ধুমধামে পালনের ঘোষণা। পাঁচ, মহারাষ্ট্রে গো-হত্যায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এবং ছয়, গোয়ায় সরকারি ছুটির তালিকায় গাঁধী জয়ন্তী না থাকা নিয়ে বিতর্ক। গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত পার্সেকর অবশ্য আজ জানিয়েছেন, তাঁর সরকার এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। হয়তো ছাপার ভুল রয়েছে তালিকায়।
জমি অধ্যাদেশের বিল প্রত্যাহারের দাবিতে কাল সংসদ ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নিয়েছে কংগ্রেস। পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের দিল্লিতে এনে সংসদের বাইরে তুলকালাম বাধানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সংসদেও মোদীর জমি নীতির বিরোধিতা করে হইচই বাধাতে চান কংগ্রেস নেতারা।
এরই পাশাপাশি রাহুল গাঁধীর বাড়িতে পুলিশের ‘চরবৃত্তি’ নিয়ে কংগ্রেস তথা বিরোধীরা যে কাল প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করবেন, তা-ও আজ স্পষ্ট করে দেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতা আনন্দ শর্মা। সাংবাদিক বৈঠক করে আনন্দ বলেছেন, “রাহুল গাঁধী এসপিজি নিরাপত্তা পান। যার অর্থ রাহুলের গতিবিধি নিয়ে সব তথ্যই সরকারের কাছে রয়েছে। তা সত্ত্বেও রাহুলের বাসভবনে পুলিশের যাওয়াটা সন্দেহজনক। বিশেষ করে প্রশ্নের তালিকায় যে তথ্যগুলি জানতে চাওয়া হয়েছে, তা থেকে সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছে।” আনন্দ শর্মা তথা কংগ্রেসের অভিযোগ, গুজরাতে মোদী সরকারের আমলে ঠিক এ ভাবেই বিরোধীদের উপর চরবৃত্তি করা হতো। এখন শুধু কংগ্রেস নয়, সব বিরোধী দলের নেতাদের উপরেই নজর রাখা হচ্ছে। এটা ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ। আনন্দ শর্মার পাশাপাশি শশী তারুরও আজ বলেন, সরকারের এই আচরণ গণতন্ত্রের পক্ষেও ক্ষতিকর। অন্য বিরোধী দলগুলিও এ নিয়ে সমান ক্ষুব্ধ।
রাহুলের বাড়িতে পুলিশ পাঠানোর পাশাপাশি কংগ্রেস চটেছে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যাকারীদের জন্মদিন পালনের ব্যাপারে পঞ্জাবের শাসক দল অকালি দলের মদত নিয়ে। প্রতি বছর ওই রাজ্যে নানকশাহী ক্যালেন্ডারে সারা বছরের উৎসব উদ্যাপনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়। শিরোমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটি ওই ক্যালেন্ডার ঘোষণা করে। বরাবরই যাদের সঙ্গে অকালির নিবিড় সম্পর্ক। কার্যত তারা এক আত্মা। আনন্দ শর্মা এ প্রসঙ্গে বলেন, “প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে যারা হত্যা করেছে, তাদের জন্মদিন পালন হতে চলেছে পঞ্জাবে। অথচ সেখানে জোট সরকারে থেকেও বিজেপি এ ব্যাপারে নীরব। কংগ্রেসের প্রশ্ন, এই কার্যকলাপ কি দেশবিরোধী নয়? নাকি রাজনীতির স্বার্থে এখন এ সবও মেনে নিচ্ছে বিজেপি।” দেশবিরোধী কাজকর্মের প্রশ্নে কাশ্মীর নিয়েও মোদীকে এক হাত নেন কংগ্রেসের ওই শীর্ষ নেতা। বলেন, “প্রধানমন্ত্রী সংসদে জাতীয়তাবাদ নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। অথচ পঞ্জাব ও জম্মু-কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদের রাজনীতিতেই মদত দিচ্ছে তাঁর দল।”
বিরোধী শিবির শাসক পক্ষের সমালোচনা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সন্দেহ নেই এই বিষয়গুলি নিয়ে সরব হয়ে সরকার বিরোধিতার বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং সংসদ ভন্ডুল করার ক্ষেত্রে এগুলিই হতে চলেছে বিরোধী পক্ষের হাতিয়ার। আগামী পাঁচ দিন সংসদ কার্যত অচল করে রাখলে সরকার কিছুটা প্যাঁচে পড়ে যাবে। সংসদের চলতি অধিবেশনে বাকি তিনটি অধ্যাদেশ পাশ না হলে সেগুলির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এর মধ্যে কয়লা খনি বণ্টন বিলটি ইতিমধ্যেই সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে বাধ্য করেছে বিরোধীরা। সিলেক্ট কমিটির সুপারিশ বুধবার পেশ হওয়ার কথা। সুপারিশের খসড়া তৈরির আগে আজ ছিল কমিটির শেষ বৈঠক। সেখানে কংগ্রেসের সদস্যরা প্রশ্ন তোলেন, খনি নিলামের পরে নতুন হাতে যাবে। কিন্তু তার শ্রমিকরা নতুন মালিকানায় চলে যাওয়া খনিতে কাজ করতে পারবেন কি না, সেই বিষয়টি স্পষ্ট নয় বিলে। শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রম আইনের বিষয়গুলি যোগ করতে হবে বিলে। এই সিলেক্ট কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ১১ জনই বিরোধী শিবিরের। ফলে কমিটির রিপোর্টে বিরোধীদের বক্তব্য গুরুত্ব পাবে। সরকার তা না মানলে সংসদে হুলস্থুল বাধাবেন বিরোধীরা। সরকারকে বিলটি ফের লোকসভায় পাঠাতে হবে সংশোধনের জন্য। ফলে চলতি অধিবেশনে ওই বিলটির পাশ হওয়া বেশ শক্ত।
তবে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর কিন্তু আজও প্রত্যয়ের সঙ্গে দাবি করেছেন, “জমি বিল আগামী সপ্তাহে পাশ করে ফেলবে সরকার।” বিরোধীরা এককাট্টা থাকলে রাজ্যসভায় কী ভাবে ওই বিলগুলি পাশ করানো সম্ভব, সেই ব্যাখ্যা অবশ্য দেননি জাভড়েকর। তবে অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডুরা এখনও বিরোধী ঐক্য ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা বিফল হলে? বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা এত দিন বলে এসেছেন, দরকারে যৌথ আধিবেশন ডেকে বিল পাশ করানো হবে। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, চলতি বাজেট অধিবেশনে পাশ না হলে, মেয়াদ ফুরনোর মুখে ফের ওই অধ্যাদেশগুলি জারি করার কথাও ভাবতে হচ্ছে মোদী-শিবিরকে। এর আইনি দিকগুলি ইতিমধ্যেই খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে সরকার।