রাজ্য প্রাণী বাঘরোল। — ফাইল চিত্র।
রাতের বেপরোয়া যানবাহনে হাওড়ায় ক্রমশই বিপন্নতা বাড়ছে বাঘরোলের। মঙ্গলবার ভোররাতে পাঁচলার অদূরে রানিহাটি-আমতা রাজ্য সড়কে গাড়ির ধাক্কায় একটি বাঘরোলের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে, বাগনানে জাতীয় সড়কে সোমবার রাতে দুর্ঘটনার গুরুতর জখম হয়েছে একটি বাঘরোল।
রাজ্য-প্রাণী হিসাবে তকমা পাওয়া বাঘরোলের দক্ষিণবঙ্গে অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হাওড়ার দামোদর এবং রূপনারায়ণ নদের অববাহিকার নিচু জলাজমি। বন দফতর ও পরিবেশপ্রেমী সংগঠনগুলির ধারাবাহিক প্রচারে পিটিয়ে বা বিষ দিয়ে মারার ঘটনা সামান্য কমলেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেপরোয়া যানবাহন। স্থানীয় সূত্রে খবর, সোমবার রাতে বাগনানে মুম্বইগামী জাতীয় সড়কের লাইব্রেরি মোড় থেকে বাসস্ট্যান্ড ঢোকার রাস্তায় একটি বাঘরোল রাস্তা পারাপার করছিল। সেই সময় একটি দ্রুতগামী বাস বাঘরোলটিকে ধাক্কা মারে। আহত বাঘরোলটি কোনও রকমে রাস্তার পাশে গিয়ে একটি ঝোপে বসে থাকে। শুভঙ্কর মাইতি নামে খালোড়ের এক যুবক ঘটনা দেখেই এলাকার ছেলেদের কাছ থেকে জেনে যোগাযোগ করেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণকারী চিত্রক প্রামাণিকের সঙ্গে।
ঘটনার কথা শুনেই চিত্রক এবং তাঁর সহযোগী সুমন্ত দাস, ইমন ধাড়া ও রঘুনাথ মান্না ঘটনাস্থলে আসেন। তত ক্ষণে ঘটনাস্থলে প্রচুর লোক জমা হয়। আহত বাঘরোলটি যেখানে বসেছিল, তার পাশ দিয়েই দ্রুতগামী গাড়ি চলাচল করছিল। লোক দেখে প্রাণীটি ভয় পেয়ে যাতে রাস্তায় না চলে যায় তাই উদ্ধারকারীরা ঝুঁকি নিয়েই বাঘরোলটিকে ধরে খাঁচাবন্দি করেন। দেখা যায় তার কোমর ভেঙে গিয়েছে। বন বিভাগে খবর দেওয়া হলে উলুবেড়িয়া রেঞ্জের বনকর্মীরা রাতেই গাড়ি নিয়ে এসে বাঘরোলটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। হাওড়ার বিভাগীয় বনাধিকারিক দীপক মণ্ডল বলেন, ‘‘রাতেই গড়চুমুক প্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রের পশু হাসপাতালে এনে বাঘরোলটির চিকিৎসা শুরু হয়েছে।’’
চিত্রক মঙ্গলবার বলেন, ‘‘প্রায়ই গ্রামীণ হাওড়ার বিভিন্ন জায়গায় গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ যাচ্ছে বাঘরোলের। বাঘরোল বা মেছোবিড়াল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রাণী। ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এরা তফসিল-১, অর্থাৎ সর্বোচ্চ গুরুত্বের সংরক্ষণে আওতায়। হাওড়ার মতো জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এদের সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা প্রয়োজন।’’ রাজ্য বন্যপ্রাণ উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য তথা বন্যপ্রেমী সংস্থা ‘শের’-এর কর্ণধার জয়দীপ কুন্ডু বলেন, ‘‘রাজ্য প্রাণীর তকমা দেওয়া হলেও যদি বাঘরোল সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ করা যায়, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’ চলতি মাসেই হাওড়ার জগৎবল্লভপুরে বাঘরোল মেরে মাংস খাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল বলেও জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতি ‘নারীরত্ন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত বাঘরোল গবেষক তিয়াসা আঢ্য জানান, গত এক বছরে হাওড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৮টি বাঘরোলের পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে ১৩টিই মেয়ে বাঘরোল। যা সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, ‘‘হাওড়া জেলায় বাঘরোলের বসতি বিভিন্ন জলাজমিগুলি বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। তার মধ্যে দিয়ে রয়েছে রাস্তা। ফলে একটি জায়গা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়ার সময় তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।’’ বেপরোয়া যানের কবল থেকে বাঘরোল বাঁচাতে গতি নিয়ন্ত্রণ বা আন্ডারপাস তৈরির মতো পদক্ষেপে কাজ হতে পারে বলে জানান তিনি। তবে এ কাজ শুধু বন দফতরের পক্ষে সম্ভব নয় বলে জানিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘জেলা প্রশাসন, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত এবং পুলিশকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে।’’