পর পর মারা গিয়েছিলেন কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা। গ্রামের পুজারি ও তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, ৬৩ বছরের ‘ডাইনি’ পনি ওরাংই তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তাই আজ সকালে ওই বৃদ্ধাকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলি দিল ওই গ্রামের বাসিন্দারা। অসমের শোণিতপুর জেলার ভীমাজুলি ১ নম্বর গ্রামের এই ঘটনা ফের প্রমাণ করে দিল, ডাইনি অপবাদে খুন রুখতে অসম সরকারের উদ্যোগে বিশেষ ফল হচ্ছে না।
অসম-অরুণাচল সীমানায় ভীমাজুলি ১ নম্বর গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ কার্বি। অন্যেরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের। কয়েক মাসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনার পরে তারা ভয় পেয়ে পুজো দেয়। তখনই গ্রামের পুজারি ডেলিরাম বে ও তার স্ত্রী অনিমা রংহাংপি ঘোষণা করে, পনি ওরাং ডাইনি বিদ্যা চর্চা করেন। তাঁর জন্যই মৃত্যু হচ্ছে গ্রামে। পুলিশ জানিয়েছে, অনিমা নিজেকে ‘লক্ষ্মীদেবীর অবতার’ হিসেবে প্রচার করে। তাই ডেলিরাম ও অনিমার কথায় কার্যত অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে গ্রামের বাসিন্দাদের।
পনি ওরাংয়ের দিকে পুজারি ও তার স্ত্রী আঙুল তোলার পরে আর বেশি সময় নষ্ট করেনি গ্রামবাসীরা। আজ সকালে জনতা হানা দেয় তাঁর বাড়িতে। দুই সন্তানের মা পনিদেবীকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় ঢুলি নদীর পাশে। সেখানে গাছের গুঁড়ির উপরে রেখে তাঁকে বলি দেওয়া হয়। দেহ পুঁতে দেওয়া হয় নদীর চরে।
খবর পেয়ে বিকেলে গ্রামে যায় পুলিশ। কিন্তু রুখে দাঁড়ায় গ্রামবাসীরা। তারা দাবি করে, ‘ডাইনিকে’ বাঁচিয়ে রাখলে ক্ষতি হতো। তাই তাঁকে বলি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত বুঝে অতিরিক্ত বাহিনী চেয়ে পাঠান ভীমাজুলিতে হাজির পুলিশ অফিসারেরা। পরে গ্রামে পৌছয় পুলিশ ও এসএসবি-র বিশাল যৌথ বাহিনী। নদীর চরের মাটি খুঁড়ে দেহ উদ্ধার করেন জওয়ানেরা। গ্রাম থেকে পুজারি ডেলিরাম বে, নরেন রং হাং ও রাজু বে নামে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বলি দেওয়ার দা-ও। অনিমার দু’মাসের শিশু থাকায় তাকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। ভীমাজুলিতে আধাসেনা মোতায়েন রয়েছে।
চলতি মাসেই কার্বি আংলং-এর ভোকসুং গ্রামে এক মহিলাকে ডাইনি অপবাদে হত্যা করা হয়েছিল। মে মাসে শোণিতপুরের তরাজুলিতে ৫ বছরের শিশুকে বলি দেয় এক তান্ত্রিক। ডাইনি অপবাদে খুন রুখতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন সমাজকর্মী দিব্যজ্যোতি শইকিয়া। তিনি জানান, ২০০১ সাল থেকে এই বছর অবধি প্রায় ১৮৫ জন ডাইনি অপবাদে খুন হয়েছেন।
সরকারি হিসেবই বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি অবধি ৭৭ জনকে ডাইনি অপবাদে খুন হতে হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ জন মহিলা। ৪২ জন পুরুষ। জখমের সংখ্যা ৬০। সরকারি সমীক্ষাই বলছে, সাঁওতাল, কার্বি, বড়ো, রাভা, মিসিং ও হাজোং এলাকায় এই ঘটনা বেশি ঘটে। কার্বি, সাঁওতাল, মিসিংদের মধ্যে বাড়ছে স্বঘোষিত ‘অবতারের’ সংখ্যাও। অনিমার মতো অনেক ‘অবতারের’ প্ররোচনায় এই ধরনের ঘটনা ঘটে। ভৌগোলিক দিক থেকে ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনা বেশি ঘটে গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড়, চিরাং, শোণিতপুর, বাক্সা, উদালগুড়ি, কার্বি আংলং, ধেমাজি, যোরহাট (মাজুলি) জেলায়। অসমে ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনার সংখ্যা বেশ বেশি। সমাজকর্মীরা জানাচ্ছেন, অনুন্নত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করার ক্ষেত্রে এখনও বিশেষ সাফল্য পায়নি প্রশাসন।
পুলিশ কর্তারা জানাচ্ছেন, ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেহেতু জনতা জড়িত থাকে, তাই নির্দিষ্ট কেউ ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও মামলা গড়াতে থাকে। অভিযুক্তেরা প্রমাণের অভাবে জামিন পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ডাইনি অপবাদে খুনের পিছনে থাকে জমি দখলের চক্রান্ত।
তবে সম্প্রতি ডাইনি অপবাদে খুনের মামলায় কয়েকটি ব্যতিক্রমী রায় দিয়েছে উদালগুড়ি, কোকরাঝাড় ও চিরাং জেলা আদালত। মে মাসে চিরাং আদালত ডাইনি অপবাদে রমন নার্জারি (৫৫) ও তাঁর স্ত্রী বুলাউ (৫০)-কে কুপিয়ে খুনের মামলায় ৭ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ২০১১ সালে রমন ও নার্জারি খুন হয়েছিলেন। জুলাই মাসে উদালগুড়ি জেলা আদালত পানেরির গিগরা ওঁরাওকে ডাইনি অপবাদে খুনের ঘটনায় ১৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই ঘটনাটি গত বছরের। জুন মাসে বুদরাই কিসকু নামে এক ব্যক্তিকে ডাইনি অপবাদে সৎ মাকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় কোকরাঝাড় আদালত
ডাইনি অপবাদে খুন রুখতে অসমের প্রস্তাবিত আইন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কড়া বলে তরুণ গগৈ সরকারের দাবি । এই আইনে ডাইনি অপবাদে অত্যাচার বা খুনের ক্ষেত্রে ৩ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা থাকছে। পাশাপাশি, ‘ওঝা’, ‘বেজ’, ‘অবতার’ হিসেবে কাউকে ‘ডাইনি’ বলে চিহ্নিত করলে, একঘরে করলে, মানসিক নির্যাতন করলেও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ডাইনি অপবাদে অত্যাচারিতকে পুনর্বাসন দেওয়া ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বিলে। সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই ধরনের ঘটনার দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গড়া হবে। তদন্তে গাফিলতির প্রমাণ মিললে শাস্তির মুখে পড়তে পারে পুলিশও। ডাইনি অপবাদে খুন বা অত্যাচারের ঘটনাকে জামিন অযোগ্য ধারাতে ফেলা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় ৩০২ বা খুনের ধারা প্রয়োগের সুপারিশও রয়েছে প্রস্তাবিত বিলে।
সমাজকর্মী দিব্যজ্যোতিবাবুর দাবি, স্বরাষ্ট্র দফতর কড়া আইন তৈরির কথা বললেও তা বিধানসভায় আনতে বহু দেরি করছে। ১ অগস্টের আগে প্রস্তাবিত বিল জমা না পড়লে তা নিয়ে বিধানসভার অগস্ট অধিবেশনেও আলোচনা হবে না। তা ছাড়া পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য দফতর এক সঙ্গে কাজ করে পিছিয়ে পড়া এলাকায় সার্বিক উন্নয়ন না আনতে পারলে এ জিনিস কমবে না বলে মনে করেন দিব্যজ্যোতিবাবু। সারা অসম কার্বি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি মঙ্গল বে-ও মনে করেন, গ্রামগুলিতে পর্যাপ্ত শিক্ষার আলো না পৌঁছনোর ফলেই কুসংস্কার কাটছে না।
তাই এখনও অন্ধ জনতার শিকার হতে হচ্ছে পনি ওরাংদের।