বিজয়কুমার ধর
১৯৫১ সালে নাকি জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাও আবার অসমের সব জেলায় তৈরি হয়নি। তাহলে এনআরসি-ই বা কী, আর তার নবায়ন বা সংশোধনেরই বা অর্থ কী?!!!
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে বাঙালির আত্মোত্সর্গ উল্লেখযোগ্য—স্বাধীনতা লাভে সে জাতিরই দুর্ভোগের সীমা নেই! দেশ বিভাগে বাংলার মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া, দেশ ছাড়া হল। অথচ সাধারণ মানুষ জানতেই পারল না তাদের অপরাধ কী? এই দুর্ভোগের কথা জানতে পারলে বোধহয় আমরা স্বাধীনতাই চাইতাম না! নিজের দেশেই উদ্বাস্তু—অদৃষ্টের পরিহাস এখনও তাড়া করে ফিরছে।
স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই এই দুর্ভোগের শুরু। ১৮৭৪ সালে ইংরেজ সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বাংলাভাষী সমগ্র শ্রীহট্ট জেলা-সহ গোয়ালপাড়া জেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকা ঢাকা বিভাগ থেকে ছিন্ন করে অসম প্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। সেই থেকেই কিছু কিছু বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি নিয়ে—রেল, ডাক বিভাগ এবং চা-বাগানগুলিতে চলে আসেন। কার্যত তারাই তো অসমের আদি বাসিন্দা অর্থাৎ ‘খিলঞ্জিয়া’। তারা বিদেশি হয় কী করে? ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট দেশ ভাগের ফলে শ্রীহট্ট বা সিলেট বা অন্য অ়ঞ্চল থেকে যারা অসমে এসেছে, তারা সবাই ভারতীয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে দেশের যে কোনও স্থানে অন্য স্থানের লোকদের বসতি স্থাপনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। যার ফলে পূর্ব বাংলার প্রচুর লোক অসমে আসে। বিশেষ করে কৃষক শ্রেণির লোক—যারা পাহাড়, জঙ্গল কেটে হিংস্র প্রাণী, দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে, অনাবাদি জমিতে সোনার ফসল ফলিয়েছে। তারা স্থানীয় বাসিন্দা নয়?
পরবর্তী কালে কিছু কিছু অসমিয়া বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা সার্বিক বিষয়টিকেই অন্য চোখে দেখতে আরম্ভ করলেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাক্-মুহূর্তে পাকিস্তানে সংযুক্তির গণভোটে শ্রীহট্টকে অসম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ‘ষড়যন্ত্রে’ সাহায্য করেছেন কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা।
স্বাধীনতার পর থেকেই অ-অসমিয়া জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বাঙালির উপরে একটার পর একটা দুর্যোগ নেমে আসে অসমে। বিগত প্রায় প্রতিটি দশকে বাংলা ও হিন্দিভাষীদের উপর নানা রকম অত্যাচার আরম্ভ হয়। ১৯৬০ সালে অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের এক মাত্র রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আইন প্রণয়ন এবং তৎপরবর্তী ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন বাংলাভাষীদের, বিশেষ করে হিন্দু বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে ভয়ানক দুর্যোগ। বাঙালিদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, লুণ্ঠন করে, হত্যা করে, শিশু-সহ মহিলাদের উপর অত্যাচার করে, এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল। সভ্য জগতে তার তুলনা খুব কম। কত লোক যে প্রাণ হারিয়েছে, কত যে ঘর ছাড়া হয়েছে, কত মানুষ রাজ্য ছাড়া হয়েছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
এর পরেই এল বিদেশি আন্দোলন। রব উঠল ‘আসাম ফর আসামিজ’। এল গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের প্রস্তাব—বাংলাকে অবহেলা করে শুধু মাত্র ইংরাজি ও অসমিয়াই হবে শিক্ষার মাধ্যম। অসম মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সার্কুলার জারি হল, অ-অসমিয়াদের বাধ্যতামূলক ভাবে অসমিয়া ভাষা শিক্ষা করতে হবে। সবই পরিকল্পনা মাফিক—যদিও শেষ পর্যন্ত সেগুলির কোনওটাই ধোপে টেকেনি, উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ‘বিদেশি হঠাও’ আন্দোলনের ফলশ্রুতি ‘অসম অ্যাকর্ড’। যার ফলে অ-অসমিয়া জনগোষ্ঠীরা বিব্রত বোধ করল। প্রথমাবস্থায় বাঙালি হিন্দুরা টার্গেট হলেও পরবর্তী কালে বাঙালি মুসলিমরাও বাদ যায়নি। যদিও অসমে মুসলিম অনুপ্রবেশ অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অত্যাচার বন্ধ হবে বলেই ভেবেছিলাম—কিন্তু না, তা হয়নি। শেখ মুজিবের সোনার বাংলা আর ধর্মনিরপেক্ষ দেশ থাকেনি। ধর্মান্ধ লোকেদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বাঙালি হিন্দুরা দলে দলে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিল। এই সব নির্যাতিত হিন্দু শরণার্থীদের প্রতি অমানবিক মনোভাব নিয়ে অসমিয়া বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের নাগরিকত্বের বিরোধিতা করেন। প্রশ্ন অসম ভারতবাসীর, নাকি অসমিয়াদের? শিকড় যাদের ভারতে, তারা তো শাসকের রাজনীতির শিকার হয়ে ছিন্নমূল হয়ে যেতে পারে না। কিছু দিন পর পর বঙ্গাল খেদা, রাজস্থানি খেদা, হিন্দিভাষীদের অসম ছাড়ার নোটিস—এটাই কী দেশভক্তির নিদর্শন? ভারতে অন্য রাজ্যে বসবাসকারী অসমিয়ারা কোথায় যাবেন? পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীরা কেন বিদেশি হবেন? অসমের দু’ একটি আঞ্চলিক দল ও ছাত্রসংস্থাই কী অসমবাসীর ভাগ্য নির্ধারণ করবে?
১৯৮৫ সালের ‘অসম চুক্তি’ই কি শেষ কথা? নেহরু-লিয়াকত চুক্তি, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি—এ সব চুক্তির কি কোনও মূল্য নেই? সুপ্রিম কোর্ট নাকি ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে ভিত্তিবর্ষ ধরে নাগরিক পঞ্জি নবীকরণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আবেদন পত্রে পরিবারের যে সব বিবরণ চাওয়া হয়েছে—তা তো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে করা হয়নি। এগুলি অসম সরকারের কিছু কিছু উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী আমলা ও এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত পরিকল্পনা। প্রত্যক্ষ আন্দোলনে যা বর্তমানে সম্ভব নয়—তাই পরোক্ষে ফলপ্রসূ করাই অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। অসমের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রনেতারা বলে থাকেন—শরণার্থীর বোঝা একা অসম কেন বহন করবে? হায় রে শিক্ষা! তাঁরা কী জানেন না, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অসমের থেকে অনেক বেশি শরণার্থী আছেন। পঞ্জাব ও রাজস্থানেও অনেক শরণার্থী এসেছেন—কই তারা তো তাতে আপত্তি করেনি?
বর্তমান অসম সরকার ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করে এনআরসি নবীকরণ করার সিদ্ধান্ত যদি নিয়ে থাকেন তা হলে এনআরসি-র যে বিবরণ চাওয়া হয়েছে, তার অর্থ কী? কেন এই দ্বিচারিতা? অসমের বুদ্ধিজীবীরা এক ভয়ানক খেলায় মেতেছেন। নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারছেন। বুদ্ধিজীবীদের এ খেলা বন্ধ না হলে অসমের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
আশঙ্কা হয়, নাগরিক পঞ্জি নবীকরণ না শেষ পর্যন্ত নতুন করে আরেকটি পৃথক আন্দোলনের জন্ম দেয়। ভোটের রাজনীতি করায় কিন্তু অনেক ক্ষতি? নরেন্দ্র মোদী কী সেই ভুল আবার করবেন, না শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করবেন? বিজেপি চাইছে, অসমিয়া ভাইরাও মুখ না ফেরান, বাঙালি হিন্দুরাও বিমুখ না করেন। তরুণ গগৈ হয়তো এনআরসি তৈরির আগেই ভোট চেয়ে বসবেন। কারণ এনআরসি তৈরি হয়ে গেলে তাঁর মুসলিম ভোট কমে যাবে। দেখা যাক আমাদের ভবিতব্য কী? নাকি আমরা যে অভাগা, সেই অভাগাই থেকে যাব!
(লেখক হাইলাকান্দি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ)