নজরদারিতে ভুলের ফাঁকেই বেলাইন রেল

দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। তবু কর্মী-অফিসারেরা সতর্ক ও সক্রিয় হলে রেলের অনেক দুর্ঘটনাই এড়ানো যায় বলে মনে করেন রেলকর্তাদের একটি বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, অধিকাংশ রেল দুর্ঘটনার মূলেই পরিকাঠামোর অভাব বা নজরদারির ত্রুটি।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:০২
Share:

দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। তবু কর্মী-অফিসারেরা সতর্ক ও সক্রিয় হলে রেলের অনেক দুর্ঘটনাই এড়ানো যায় বলে মনে করেন রেলকর্তাদের একটি বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, অধিকাংশ রেল দুর্ঘটনার মূলেই পরিকাঠামোর অভাব বা নজরদারির ত্রুটি। অর্থাৎ দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণগুলো শনাক্ত করে আগে থেকে তার মোকাবিলায় নামতে পারলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায় অনেকটাই। ‘দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই’-এর মতো নিয়তি-নির্ভর আপ্তবাক্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোটা তখন আর খুব অসম্ভব থাকে না।

Advertisement

প্রাক্তন ও বর্তমান রেলকর্তাদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না-নেওয়া এবং নিলেও তার সদা-সতর্ক প্রয়োগের অভাবেই অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না। দেখভাল ও নজরদারিতে দায়সারা মনোভাব বিপত্তি ডেকে আনে। দৃষ্টান্ত হিসেবে অগস্টে কোচির কাছে ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার কথা তুলছেন তাঁরা। ওই ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার মূলেও নজরদারির ঘাটতিই উঠে এসেছে। ২৭ অগস্ট কোচির ৪৫ কিলোমিটার দূরে কারুকুট্টি স্টেশনের কাছে ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসের ১২টি কামরা লাইনচ্যুত হয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, রেললাইন ভাঙা ছিল। কিন্তু কর্মীদের দায়সারা মনোভাবের জন্য সেই ভাঙা অংশটা নজর এড়িয়ে যায়। তারই পরিণামে দুর্ঘটনা।

এই ঘটনা সামনে আসার পরে নড়েচড়ে বসেছে রেল বোর্ড। কারণ, রেলের নিজস্ব হিসেব অনুযায়ী গত ক’বছরে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার অর্ধেকই হচ্ছে লাইনচ্যুতি। তাই ম্যাঙ্গালোর এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পরে রেলের সব ক’টি জোনকে লাইনচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা ঠেকাতে নজরদারি চালাতে বলা হয়েছে। যাত্রী-নিরাপত্তা কী ভাবে বাড়ানো যায়, সেই বিষয়ে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুও রেলকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছেন বারবার। তিনি বলেছেন, শুধু ঘরে বসে বৈঠক নয়। প্রয়োজনে ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারকেও রেললাইনে নেমে সরেজমিনে পরিকাঠামোর দেখভাল করতে হবে। যাত্রী-সুরক্ষার ব্যাপারে আরও সচেতন করতে হবে কর্মীদের।

Advertisement

ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কেন?

রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, যথাসময়ে লাইন মেরামত না-হলে এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনে ট্রেন বেলাইন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় তাপমাত্রার পরির্বতনে লাইন বেঁকে যায়। ঠিক সময়ে সেটা নজরে না-এলে দুর্ঘটনা ঘটে। লাইনে ফাটল, লাইনের বাঁকের মাপ পরিবর্তনের ফলেও ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া পয়েন্ট ও রেললাইন জোড়ার জায়গায় ত্রুটি থাকলে চাকা লাইন থেকে পড়ে যেতে পারে। তার উপরে আছে মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক ত্রুটি। ট্রেনের চাকা, অ্যাক্সেল ও আন্ডার গিয়ারের ত্রুটি তার মধ্যেই পড়ে। এই সব ত্রুটি ঘটতে পারে যে-কোনও সময়েই।

এই সব সম্ভাব্য কারণ প্রতিহত করে দুর্ঘটনা আটকানোর চেষ্টা যে কর্মী-অফিসারেরাই করতে পারেন, সেই ব্যাপারে কর্তারা একমত। তাঁদের বক্তব্য, এ-সব বিপত্তির মূল কারণ রেললাইনের দেখভাল ঠিকঠাক না-হওয়া। অর্থাৎ অফিসার-কর্মীরা সেই কাজটা নিয়ম মেনে করলে, নজরদারিতে ফাঁকি না-দিলে যান্ত্রিক ত্রুটি বা প্রাকৃতিক কারণে লাইনের বিকৃতি চোখ এড়ানোর কথা নয়।

রেল বোর্ড তাই সব জোনকে দেখভাল ও নজরদারিতে জোর দিতে বলেছে। দেখতে হবে এই সব বিষয়: l লাইন মেরামতিতে গাফিলতি থাকছে কি না, কোথাও ফাটল আছে কি না বা ফাটল ধরার আশঙ্কা আছে কি না। l যে-সব জায়গায় রেললাইন ভাঙার প্রবণতা বেশি, সেই সমস্ত এলাকা চিহ্নিত করে বাড়তি নজরদারি। বছরভর লাগাতার মেরামতি চালানো। l কোথাও কোনও স্ক্রু বা নাটবল্টু উধাও হয়ে গেলে সেগুলি ফাঁকা না-রেখে নতুন যন্ত্রাংশ বসিয়ে দেওয়া। l লাইনের প্রতিটি বাঁকে জ্যামিতি মেনে বিপত্তি এড়ানোর আগাম ব্যবস্থা। l পয়েন্ট, ক্রসিং, সিগন্যাল— সব কিছু নিয়মিত খতিয়ে দেখার পরিকল্পনা দরকার। l প্রতিটি সেকশনে ট্রেনের নির্দিষ্ট গতি বজায় থাকছে কি না অথবা চালক নির্দিষ্ট গতিবেগের বিধি মানছেন কি না, সে-দিকে নজর রাখা।

রেলকর্তাদের অনেকে বলছেন, এ আর নতুন কথা কী! এই সব নির্দেশ তো রেলের সেফটি ম্যানুয়ালেই আছে। কিন্তু এক শ্রেণির অফিসার-কর্মী সেগুলো ঠিকঠাক মানেন না বলেই দুর্ঘটনা ঘাড়ে এসে পড়ে। শীতে তাপমাত্রার হেরফের বা বর্ষায় গাছ ভেঙে পড়া, জল জমার ব্যাপারেও রেল বোর্ডের সতর্কতামূলক নির্দেশ আছে। তা সত্ত্বেও বর্ষার আগে গাছগাছালির ডালপালা না-কাটায় ডাল পড়ে ওভারহে়ড বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায়, বিকল হয়ে যায় সিগন্যাল। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ট্রেন চলাচল। ভুগতে হয় সাধারণ যাত্রীদের।

এই পরিস্থিতিতে প্রভুর নতুন মোড়কে পুরনো দাওয়াই কতটা কার্যকর হয়, সেটাই দেখার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement