ফাইল চিত্র।
‘মা আর বাকিদের মেরে ফেলার জন্যই জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে।’
ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে কয়েক মুহূর্ত বাকরুদ্ধ। তার পরেই সোমা সেনের কন্যা কোয়েল ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন, “হয় ওঁরা জেলে থাকতে থাকতেই ফাদার স্ট্যান স্বামীর মতো মারা যাবেন, না হলে চলাফেরা, কাজ করার শক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবেন!”
ক্ষোভ। একই সঙ্গে দুশ্চিন্তাও। ভীমা কোরেগাঁও-এলগার পরিষদের মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১৬ জন ‘শহুরে নকশাল’-এর তালিকায় ফাদার স্ট্যান স্বামীর সঙ্গে রয়েছেন সোমা সেনও। সোমবার দুপুরে স্ট্যান স্বামী মারা গিয়েছেন। আদালতে জামিনের শুনানির আগেই। ভেন্টিলেটরে চলে যাওয়ার পরেও ৮৪ বছরের বৃদ্ধের জামিন মেলেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে কোভিড আক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে দাঁড়ানো ৮১ বছরের তেলুগু কবি ভারাভারা রাওকে ছয় মাসের জন্য জামিন দেয় আদালত। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সোমা সেন-সহ বাকি ১৪ জন এখনও জেলবন্দি।
স্ট্যান স্বামী ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের সামাজিক অধিকারের জন্য কাজ করতেন। আর বাঙালি অধ্যাপিকা সোমা সেনকে নাগপুরের মানুষ চিনতেন পিছিয়ে পড়া
মানুষের জন্য কাজ করার সুবাদে। আড়াই বছর ধরে জেলে বন্দি সোমা সেনের কন্যা কোয়েল বলেন, “ভারাভারা রাও-ও জামিন না পেলে মারা যেতেন। মায়ের মতো যাঁরা জেলে আটকে রয়েছেন, অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। ওঁদের যেন মেরে ফেলার জন্যই আটকে রাখা হয়েছে। যেমন স্ট্যান স্বামী মারা গেলেন। মর্মান্তিক!”
আড়াই বছরের পুরনো মামলা। তিনটি চার্জশিট। ১৬ জন অভিযুক্ত। চার জন শিক্ষাবিদ, তিন জন আইনজীবী, দু’জন সাংবাদিক, এক জন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, এক জন সমাজকর্মী, এক জন কবি, তিন জন সাংস্কৃতিক কর্মী আর এক জন জেসুইট যাজক। ভারাভারা রাও একমাত্র জামিন পেয়েছেন। স্ট্যান স্বামী বন্দি অবস্থাতেই হাসপাতালে মারা
গেলেন। নাগপুরের ৬১ বছরের অধ্যাপিকা সোমা সেন, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেরা, শিক্ষাবিদ আনন্দ তেলতুম্বডে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যানি বাবু, সমাজকর্মী রোনা উইলসন, ভার্নন গঞ্জালভেস, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সুধীর ধাওয়ালের মতো ১৪ জন এখনও জেলে বন্দি। কোথায় দাঁড়িয়ে
ভীমা কোরেগাঁও-এলগার
পরিষদের মামলা?
মোদী জমানায় দলিতদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০১৮-র ১ জানুয়ারি পুণের ভীমা কোরেগাঁওয়ে পেশোয়াদের বিরুদ্ধে দলিতদের যুদ্ধ জয়ের ২০০ বছর পূর্তি উদ্যাপন হয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়ায়। দলিতদের উপরে হামলা করার অভিযোগে প্রথমে মামলা হয় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার পরেই পুণে পুলিশ তার এক বছর আগের দলিত, সমাজকর্মীদের এলগার পরিষদ অনুষ্ঠানের তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ ওঠে, মাওবাদীদের মদতে সমাজকর্মীরা হিংসার পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের পরিকল্পনাও ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ইউএপিএ-র ধারায় মামলা হয়। এনআইএ-কে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশে একটি আমেরিকান সংস্থা ফরেনসিক তদন্ত করে জানিয়েছে, রোনা উইলসনের ল্যাপটপে কারচুপি করে মাওবাদীদের চিঠি ঢোকানো হয়েছিল, যাতে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রমাণ করা যায়। এনআইএ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আড়াই বছর কেটে গিয়েছে। কেউই এখনও দোষী সাব্যস্ত হননি। কিন্তু ইউএপিএ-র মতো কড়া আইনের জন্য ভারাভারা ছাড়া কেউ জামিনও পাননি। একের পর এক জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে। সুধা ভরদ্বাজের জামিনের আবেদনে চলতি সপ্তাহে ফের শুনানি হবে। অভিযুক্তদের মধ্যে সুধা, সোমার মতো মহিলারা এখন বাইকুল্লা জেলে বন্দি। বাকিরা নভি মুম্বইয়ের বাইরে তালোজা জেলে। অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব।
রবিবারই তালোজা জেলে বন্দি আনন্দ তেলতুম্বডের স্ত্রী রমা ও ভার্নন গঞ্জালভেসের স্ত্রী সুজ়ান বম্বে হাই কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন, জেল কর্তৃপক্ষ পরিবার ও আইনজীবীকে পাঠানো চিঠি আটকে রাখছে। রমা তেলতুম্বডে সংবিধানের প্রণেতা বি আর অম্বেডকরের নাতনি। তাঁর অভিযোগ, ৭২ বছর বয়সি আনন্দের একটি নিবন্ধ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তার পরই জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে শো-কজ় করেন।
মে মাসে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মহারাষ্ট্রে ধাক্কা দেওয়ার পরে বন্দিদের পরিবারের সদস্যরা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে চিঠি লিখে আর্জি জানিয়েছিলেন, জেলে কোভিডের সংক্রমণ, শারীরিক অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়া হোক। সুরাহা মেলেনি। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তালোজা জেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা তেমন ভাল নয়। অন্তত চার-পাঁচজন কোভিডে সংক্রমিত হয়েছেন। অধ্যাপক হ্যানি বাবুর চোখে মারাত্মক সংক্রমণ হয়েছিল। তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়। কোয়েল বলেন, “স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো এই অবহেলা। এটা লজ্জার।”