সুষমা-বসুন্ধরা বিতর্কে ইতি চান মোদী, দায়িত্বে জেটলি

সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর আগেই সুষমা স্বরাজ এবং বসুন্ধরা রাজেকে নিয়ে চলতে থাকা বিবাদের নিষ্পত্তি চান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এই কারণে তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে পুরো বিষয়টির উপর একটি নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দিলেন।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ১৬:৫৮
Share:

সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর আগেই সুষমা স্বরাজ এবং বসুন্ধরা রাজেকে নিয়ে চলতে থাকা বিবাদের নিষ্পত্তি চান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এই কারণে তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে পুরো বিষয়টির উপর একটি নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করার দায়িত্ব দিলেন।

Advertisement

অতীতে মনমোহন সিংহের জমানায় যে ভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’-এর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে, এখন নরেন্দ্র মোদীর জমানাতে অরুণ জেটলি ঠিক সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলে মনে করছেন অনেক বিজেপি নেতা। বিতর্কটি শুরু ক্রিকেট রাজনীতি থেকে এবং আইনি জটিলতাও বিস্তর। তার পাশাপাশি বিরোধী দলও অভিযোগ করছে, ভারত সরকার অন্য রাষ্ট্র থেকে যাঁকে ফেরত পাঠানোর জন্য সরকারি ভাবে আবেদন করছে, তখন কোনও মন্ত্রী তাঁকে সে দেশে বসবাসের সমর্থন জানাতে পারেন না। এই পরিস্থিতিতে এর আইনি ব্যাখ্যাটাও সঠিক ভাবে জানতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই অনুসন্ধানের জন্য আজ অরুণ জেটলি তাঁর প্রস্তাবিত চিন সফরটি বাতিল করলেন। সুষমা স্বরাজ এখন তাইল্যান্ডে। তিনি ফিরছেন ৩০ জুন। সুষমা ফিরলে অরুণ জেটলি তাঁর সঙ্গেও পৃথক বৈঠকে বসবেন।

গতকাল দুপুরে অরুণের বাড়িতে বসুন্ধরার মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ ছিল। ঠিক ছিল, নীতি আয়োগের বৈঠক সেরে বসুন্ধরা অরুণের কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাসভবনে আসবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও অরুণ জেটলি-সহ সম্ভাব্য বাড়িগুলির সামনে এত সংবাদমাধ্যম ছিল, যে তখন ফোনে বসুন্ধরা অরুণকে জানিয়ে দেন, এই বৈঠক এখন না করাই ভাল। কিন্তু অরুণের কাছে বসুন্ধরা এই বিষয়ে সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়েছেন। অরুণ যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখনই নিতিন গডকড়ীর হাত দিয়ে বসুন্ধরা ললিত মোদী সম্পর্কে একটি ফাইল তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা করছিলেন জেটলির আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার জন্য।

Advertisement

প্রাথমিক ভাবে অরুণ এই কাগজপত্রগুলি দেখেছেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর আইনি মতামত দিয়েছেন। বলেছেন, কোনও ভাবেই আইনের চোখে বসুন্ধরাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাচ্ছে না। এমনকী বসুন্ধরার পুত্র দুষ্মন্তের শেয়ার কেনার বিষয়টিতেও বসুন্ধরাকে সমর্থনই জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, কোনও ভাবেই দুর্নীতি প্রমাণ হচ্ছে না। তবে বিজেপির মধ্যে অবশ্য এখন বসুন্ধরা বনাম সুষমা স্বরাজের রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠেছে। অরুণ জেটলি আইনগত দিক থেকে বসুন্ধরাকে শংসাপত্র দিয়ে দিলেও বসুন্ধরা বিরোধী নেতারা কিন্তু এখনও ইস্তফার দাবি করে চলেছেন সংসদের অধিবেশনের আগেই। তাঁরা বলছেন, আইনের চেয়েও বড় প্রশ্ন হল নৈতিকতা। ললিত মোদীর মত একজন ব্যক্তি, যাঁকে ভারত সরকার অপরাধী বলে মনে করছে ও তদন্ত করছে, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা এবং তাঁর অভিবাসনের জন্য ব্রিটেন সরকারের কাছে দরবার করা- এ সবই ঘোরতর আপত্তিজনক।

সুষমা স্বরাজের ইস্তফা না চাইলেও দলের ভিতরের খবর, লালকৃষ্ণ আডবাণী কিন্তু বসুন্ধরার ইস্তফার পক্ষে। আসলে আডবাণী সুষমা স্বরাজের নয়, চাইছেন বসুন্ধরা ইস্তফা দিন। কিন্তু আইনি মতামত অনুসারে সুষমা স্বরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগটি বসুন্ধরার থেকে বেশি জটিল। কারণ, উনি বিদেশমন্ত্রী। দেশের ভিতরে অভিযুক্ত কোনও ব্যক্তির জন্য সরাসরি অন্য দেশের হাইকমিশনারকে ফোন করে অভিবাসন চাইবেন, সেটি মন্ত্রীর আচরণবিধির বিরুদ্ধে। আরও জানা গিয়েছে, সুষমা স্বরাজের আইনজীবী স্বামী স্বরাজ কৌশল এবং তাঁর কন্যা কী ভাবে ললিত মোদীর সাহায্য পেয়েছেন। সুষমা স্বরাজের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, অরুণ জেটলি আসলে তাঁর মুন্ডপাত করতে চাইছেন। কিন্তু বসুন্ধরার নয়।

ললিত মোদী সম্পর্কে যে তদন্ত ব্রিটেন সরকারের তদন্তকারী অফিসাররা করছেন, সেটাও জানতে চেয়েছে ভারত সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ব্রিটেনের গোয়েন্দা অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। তিনি লন্ডনে গিয়ে ওই তদন্তকারী অফিসারদের সঙ্গে খুব শীঘ্রই একটি বৈঠক করতে পারেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, ঘটনার সূত্রপাত ক্রিকেট গোষ্ঠীর যুদ্ধ হল এই ঘটনার আদিতে। মূল লড়াইটা ছিল ললিত মোদী বনাম শ্রীনিবাসনের। অভিযোগ, ললিত মোদী শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের একটি সংস্থাকে দিয়ে ফোনে আড়ি পাতার বন্দোবস্ত করেছিলেন। এই সময় শুধু শ্রীনিবাসন নন, তিনি অরুণ জেটলি, নিতিন গডকড়ীর ফোনেও না কি আড়িপাতার কাজ করিয়েছিলেন। আবার এর বদলা নিতে গিয়ে শ্রীনিবাসনও এক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিয়ে ললিত মোদী, সুষমা স্বরাজ থেকে এমনকী কীর্তি আজাদ পর্যন্ত পাল্টা আড়ি পাতার ব্যবস্থা করেছিলেন।

এই ষড়যন্ত্র ও পাল্টা ষড়যন্ত্রের ফলেই আচমকাই এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ললিত মোদীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে সুষমা স্বরাজ যখন ফোনে ব্রিটেনের হাইকমিশনার জেমস বেভানকে অনুরোধ করেছিলেন, তখন সেটির কোনও রেকর্ড ছিল না। কিন্তু ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংসদ কেথ ভেজ মেইল করার পর সুষমার সাহায্যের কথাটি সামনে এসে যায়। সেই মেইলটি স্বরাজ কৌশলকেও ‘কপি’ করা হয়। কেন স্বরাজ কৌশলকে ‘কপি’ করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তদন্তকারী সংস্থা তখন তদন্ত করে দেখে, আইনজীবী হিসেবে সুষমা স্বরাজের স্বামীকে সেটি পাঠানো হয়েছে। স্বরাজের বিরুদ্ধে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও ওঠে। আরও জানা যায়, সুব্রহ্ম্যণম স্বামীর এক সচিব নীরজ গুন্ডে, যিনি আরএসএসের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তিনি এই সমস্ত নথি লন্ডনে বেশ কিছু সাংবাদিকের কাছে সরবরাহ করেছিলেন। এবং নীরজ গুন্ডে এখন সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে স্বীকারও করেছেন সে কথা। তাঁর কথায়, ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চাইছেন বলে সেটি করেছেন।

এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতিটা বেশ জটিল। তাই তিনি তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না। দুজনের মধ্যে একজনকে সরানো হবে, না কি দুজনকেই সরানো হবে, তা নিয়েও বিতর্কের অবসান হওয়া দরকার। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, যেটা নরেন্দ্র মোদী, অরুণ জেটলি ও অমিত শাহ একমত, সংসদের অধিবেশনের আগে যদি দুজনেই ইস্তফা দিয়ে দেন, তাহলে কি সংসদে বিরোধীরা আর কোনও অশান্তি করবে না? বিজেপি নেতারা মনে করছেন, এরপরেও বিরোধী পক্ষ রণে ভঙ্গ দেবে না। তখন তারা প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করবে। জানতে চাইবে, কেন এই দুর্নীতি হল? আবার বিজেপি নেতৃত্ব এটিও ভেবে দেখছেন, সংসদে সুষমার বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ করাটা অনেক সহজ। কারণ তিনি কেন্দ্রের বিদেশমন্ত্রী। তুলনায় বসুন্ধরা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় সংসদে বিষয়টি তোলারও কিছু বাধানিষেধ আছে। কাজেই ইস্তফা দেওয়াটাই কি সঠিক পদক্ষেপ? না কি রাজনৈতিক ভাবে মন্ত্রিসভার রদবদল করে বিতর্ক নিরসনের চেষ্টা করা উচিত?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement