কোহলির আগে এখন মোদীতেই আমোদিত হয়ে রয়েছে ঢাকা

বিরাট কোহলি দলবল নিয়ে ঢাকায় এসে পড়ার পর কী হবে তা বলা যাচ্ছে না! কিন্তু তার আগে, বাংলাদেশের সমস্ত কৌতূহল এবং অপেক্ষার কেন্দ্রবিন্দু আপাতত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর। গুলশন থেকে বনানী, হজরত শাহ জালাল বিমানবন্দর থেকে গলদঘর্ম ভি়ড়ের নিউ মার্কেট— এখানকার দিন যাপনের মধ্যে সশব্দে ঢুকে পড়েছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।

Advertisement

অগ্নি রায়

ঢাকা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০৩:৪০
Share:

বিরাট কোহলি দলবল নিয়ে ঢাকায় এসে পড়ার পর কী হবে তা বলা যাচ্ছে না! কিন্তু তার আগে, বাংলাদেশের সমস্ত কৌতূহল এবং অপেক্ষার কেন্দ্রবিন্দু আপাতত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর। গুলশন থেকে বনানী, হজরত শাহ জালাল বিমানবন্দর থেকে গলদঘর্ম ভি়ড়ের নিউ মার্কেট— এখানকার দিন যাপনের মধ্যে সশব্দে ঢুকে পড়েছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।

Advertisement

গত এক বছরে নয় নয় করে ১৮টি দেশ সফর করে ফেলেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ঘরের পাশের ঢাকায় আসা হয়ে ওঠেনি। দাপটের সঙ্গে সরকার গড়ার পর মোদীকে নিয়ে প্রতিবেশী দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষা-কৌতুহল স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। গোটা বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে যে প্রচার হয়েছে, তাতে নিপাট রাজনীতিমনস্ক নন, বাংলাদেশের এমন মানুষের মধ্যেও মোদী-দর্শনের কৌতূহল তৈরি হয়েছে যথেষ্ট। সফর নিয়ে আজই মোদী ফেসবুকে যা লিখেছেন, তাতে বাংলাদেশবাসীর এই আগ্রহ আরও বেড়েছে। তিনি বলেছেন, ঢাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি দর্শন করার জন্য তিনি মুখিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নায়ক কে তিনি অকৃত্রিম ভারতবন্ধু এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্তম্ভ বলে উল্লেখ করেছেন।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরকে ঘিরেও একই ধরনের উৎসাহ তৈরি হতে দেখেছিলাম ঢাকায়। মমতার সেই সফরও ছিল দীর্ঘ বিরতির পর। তবে সে বারে প্রতীক্ষার সঙ্গে মিশে ছিল নানা সংশয়। এ বারে কিন্তু ইতিবাচক একটি কূটনৈতিক আবহ তৈরি করেই আসছেন মোদী। স্থলসীমান্ত চুক্তিটি সংসদে সর্বসম্মত ভাবে পাশ করিয়ে বাংলাদেশের হৃদয় জয়ের কাজ কিছুটা এগিয়ে রেখেই ৬ তারিখ ঢাকার বিমানে উঠছেন মোদী। ফেসবুকে তাঁর লেখাতেও অনেকটা জায়গা পেয়েছে স্থলসীমান্ত চুক্তি সংসদে পাশ করানোর বিষয়টি। তবে এ কথা তিনি এবং তাঁর প্রতিনিধি দল, এমনকী এক দিন আগে ঢাকায় চলে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিলক্ষণ জানেন— বাংলাদেশের চাহিদার তালিকা স্থলসীমান্ত চুক্তিতেই আটকে থাকবে না। তিস্তার জল থেকে বাণিজ্য ভারসাম্য, রফতানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি— ঢাকার বিপুল চাহিদাকে বিবেচনার মধ্যে রেখে ভারতের জাতীয় স্বা‌র্থ চরিতার্থ করার কূটনীতিই এ বার মোদীর সফরের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।

Advertisement

তিস্তা নিয়ে সরকারি ভাবে যে কোনও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হবে না, তা সফরের আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এ ব্যাপারে কোনও প্রত্যাশা যাতে না তৈরি হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে চাইছে কেন্দ্র। কিন্তু মোদীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি অবশ্যই তোলা হবে বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। এ ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ঘরোয়া ভাবে কথা বলবেন বাংলাদেশ নেতৃত্ব। তবে এ ব্যাপারে দিল্লির পক্ষে যে কোনও পাকা কথা দেওয়া এখনই সম্ভব নয়, এ কথা হাসিনাও জানেন। মোদীর বিবৃতিতেও তিস্তা চুক্তির বিষয়টি অনুল্লেখিতই রয়ে গিয়েছে।

তবে কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বাংলাদেশকে দ্বিতীয় দফায় একটি বড় মাপের অর্থসাহায্য দেওয়ার ঘোষণা মোদী করতে চলেছেন ঢাকায়। ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে ঢাকাকে বাৎসরিক ১% সুদে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল নয়াদিল্লি। পরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে গিয়ে ওই ১০০ কোটির মধ্যে কুড়ি কোটি ডলার অনুদান হিসাবে ঘোষণা করে আসেন। অর্থাৎ, সে অর্থ ঢাকাকে আর ফেরত দিতে হয়নি। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে ওই টাকা খরচ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার যে ভাবে ওই অর্থ কাজে লাগিয়েছে, সম্প্রতি বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, মোদী তাঁর সফরে সামান্য সুদে আরও প্রায় ২০০ কোটি ডলার ঋণসাহায্য বাংলাদেশের জন্য ঘোষণা করবেন। কোন কোন খাতে বাংলাদেশ এই অর্থ কাজে লাগাবে, তার একটি তালিকা এর আগে দিল্লি চেয়ে পাঠিয়েছিল। পরিকাঠামো, বিদ্যুৎ, সড়ক, রেল, পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ মোট ১৫টি প্রকল্পের কথা ভারতকে জানিয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশ চাইছে ওই ২০০ কোটির মধ্যে অন্তত ৫০ কোটি ডলার অনুদান হিসাবে ঘোষণা করুক নয়াদিল্লি। তবে শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে তাঁর তুরুপের তাসটি নিজের আস্তিনেই রেখে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রথাবিরোধী ভাবনার জন্য ইতিমধ্যেই বিশ্বের নজর কেড়েছে়ন মোদী। হাসিনা সরকার আশা করছে, এ বারেও তেমন কিছু ঘটবে। তাঁর প্রথম ঢাকা সফরকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে মোদী এমন কিছু হয়তো ঘোষণা করবেন, যা চমকে দিতে পারে সকলকে। গোটা বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সাউথ ব্লকে এখনও দিবানিশি কাজ চলছে। নয়াদিল্লিতে মোদীর সফর নিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের সাংবাদিক সম্মেলন করার কথা ছিল গত কাল। কিন্তু দফায় দফায় তা পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত আগামিকাল তার সময় নির্ধারিত হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, খুঁটিনাটিগুলি এখনও চূড়ান্ত না-হওয়াতেই এই সিদ্ধান্ত।

একটি বিষয় ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে মোদীর এই সফরের মূলমন্ত্র হতে চলেছে দু’দেশের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো। গত মাসে বাংলাদেশের পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দিল্লি গিয়ে এক দফা বৈঠক করে গিয়েছেন ভারতীয় কর্তাদের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে ঘোষণা হতে চলেছে একগুচ্ছ প্রকল্প, যার মূল উদ্দেশ্য, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য চলাচল এবং অন্যান্য যোগাযোগ বাড়ানো। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস যোগাযোগের মহড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস পরিষেবাও আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হবে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তির যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারত যতটা লাভবান হবে, তারা ততটা হবে না। কিন্তু দীর্ঘ দৌত্যে ভারত তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এই যোগাযোগ চালু করার বিনিময়ে রাস্তাঘাট, সেতু তৈরি করে দিলে আখেরে লাভ হবে বাংলাদেশেরও। বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগও।

পাশাপাশি ভারত যদি যোগাযোগ, পণ্য পরিবহণ বা বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে হাই টেনশন লাইন বাংলাদেশের মধ্যে নিয়ে যায়, তা হলে তার ভাড়া হিসাবে একটি মোটা অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশের ঘরে যাবে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে অসম থেকে উত্তরপ্রদেশ যে বিদ্যুতের লাইন টানার প্রকল্প এ বার ঘোষিত হতে পারে, তার বিনিময়ে বেশ কিছুটা বিদ্যুত বাংলাদেশও পাবে। এক ভারতীয় কূটনীতিকের কথায়, ‘‘ দু’দেশের জন্যই এ’টি হল আদর্শ উইন-উইন পরিস্থিতি। ঘুরপথে মুম্বই থেকে অসমে পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল খরচ পড়ে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহণ চালু হয়ে গেলে তা অনেকটাই কমে যাবে। সেই বেঁচে যাওয়া টাকার কিছু অংশ বাংলাদেশকে মাসুল হিসাবে দিতে কোনও আপত্তি নেই।’’

মোদী তাই লিখেছেন— ভারত তো লাভবান হবেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, দক্ষিণ এশিয়ার আ়ঞ্চলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইল ফলক হয়ে উঠতে চলেছে তাঁর এই ঢাকা সফর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement