বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণের জবাবে যিনি লোকসভায় মেজাজে বক্তৃতা করলেন, তিনি নরেন্দ্র মোদী। দেশের প্রধানমন্ত্রী।
দিনের শেষে বিরোধীদের পাশাপাশি দলেরও কেউ কেউ বললেন, উনি কেমন প্রধানমন্ত্রী? কী ভাবে কথা বললেন! এমনটা কি কোনও প্রধানমন্ত্রীকে মানায়! উনি তো সেই মোদীই হয়ে রইলেন!
নোট-বাতিল নিয়ে বিরোধী ঝড়ের মুখে মঙ্গলবার লোকসভায় জবাব দিতে উঠে মোদীর দাবি, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত শুধু সঠিক নয়, এমন সময় এটা কার্যকর করা হয়েছে, যখন দেশের অর্থনীতি তৈরি ছিল পরিস্থিতি সামাল দিতে। আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর এই মন্তব্য শুনে বিরোধী বেঞ্চে গুঞ্জন উঠলেও বেশি কিছু হয়নি। পরে অবশ্য রাহুল গাঁধী টুইটে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী!’’ কিন্তু ও কথা বলার পরেই মোদী যখন সাংসদদের ‘ভাইয়ো অউর বহেনো’ বলে সম্বোধন করে বসলেন, রে-রে করে উঠল বিরোধী বেঞ্চ! দলমত নির্বিশেষে সকলের বক্তব্য — আপনি কি জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন?
প্রধানমন্ত্রী বলতেই পারতেন, সতীর্থ সাংসদেরাও তো আমার ভাই-বোন। কিন্তু মোদী তা বলেননি। বরং যা বলেছেন, তাতে বিরোধীদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। আর সেই ক্ষোভ অগ্রাহ্য করেই মোদী নাগাড়ে বলে গিয়েছেন তাঁর আড়াই বছরের সরকারের সাফল্য-গাথা!
লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর জবাব দেওয়ার কথা ছিল মঙ্গলবার দুপুর বারোটায়। গত কাল থেকে সংসদে বসে বিরোধীদের প্রত্যেকের বক্তব্য শুনেছেন তিনি। এ দিন জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসেওছিলেন। কিন্তু সভার শুরুতেই তৃণমূলের বিক্ষোভে হয়তো মেজাজটা একটু বিগড়ে গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। তার পর যখন বলতে উঠলেন, তখন প্রত্যেক বিরোধী বক্তার নাম উল্লেখ করে শুরুটায় একটা উদার মনোভাবের পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবিটা বদলে গেল।
সোমবার রাতে উত্তরাখণ্ডের ভূমিকম্পের উদাহরণ দিয়ে রাহুল গাঁধীকে খুঁচিয়ে একটু কৌতুক করতে চেয়েছিলেন। গত অধিবেশনে রাহুল বলেছিলেন, মোদীর বিরুদ্ধে মুখ খুললে ভূমিকম্প হবে। আজ সে কথার সূত্র ধরে মোদী বলেন, ‘‘ভূমিকম্প হল কেন? যখন কেউ দুর্নীতিতেও সেবা বা নম্রতা দেখেন, তখন ধরিত্রী মা দুঃখ পান। তখনই ভূমিকম্প হয়।’’ যা শুনেই তেড়ে উঠল বিরোধী শিবির। কংগ্রেস, সিপিএম-সহ সব দলের সাংসদেরা উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ভূমিকম্প নিয়েও রসিকতা করছেন আপনি? উত্তরাখণ্ডের মানুষকে অপমান করছেন? তাঁরা স্পিকারের কাছে মোদীর ওই রসিকতা প্রত্যাহারের দাবি জানাতে থাকেন। পরিস্থিতি দেখে কথা থামিয়ে দেন বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
বিরোধীরা অবশ্য ছেড়ে দেননি। আজ লোকসভায় সনিয়া গাঁধী ছিলেন না। প্রচারে ব্যস্ত থাকায় রাহুলও সংসদে ছিলেন না। তবে তিনি টুইটারে লেখেন, ‘‘রাজ্যের দুর্গতি নিয়ে রসিকতা করছেন প্রধানমন্ত্রী।’’ মোদীকে বিঁধেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও। অন্য বিরোধী নেতারাও বাদ যাননি।
আড়াই বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রথম দিন সেন্ট্রাল হলের সামনে প্রণাম করে সংসদে ঢুকেছিলেন। সে দিন সংসদে তাঁর প্রথম বক্তৃতার সময় বিরোধী নেতাদের টুঁ শব্দটি করতে দেখা যায়নি। বিপুল ভোটে জিতে আসা দলের কান্ডারী শুধু নন, মোদীর বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা যে অনবদ্য, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। সকলেই সে দিন চুপ করে শুনেছিলেন মোদীর কথা। সে দিনের সঙ্গে তফাত একটাই।
এ দিন মোদীর পৌনে দু’ঘণ্টার বক্তৃতার প্রায় প্রতিটি শব্দ নিয়ে বিরোধী শিবির মুখর হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে উড়ে এসেছে টিকা-টিপ্পনী। বেঙ্কাইয়া নায়ডু বা অনন্ত কুমারের মতো নেতারা অবশ্য পরে বলেছেন, ‘‘এ এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা। বহু দিন পর এমন আক্রমণাত্মক প্রধানমন্ত্রীকে দেখা গেল।’’
জবাবে সৌগত রায়ের মতো প্রবীণ তৃণমূল নেতার বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল হলেই তিনি এমন আচরণ করেন, যা নিয়ে সকলে ক্ষুব্ধ হন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী সুলভ আচরণ করতে না পারেন, তা হলে বিরোধীরা অপমান করছেন, এমন বলার মানে নেই।’’ কংগ্রেসের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াও বলেন, ‘‘আসলে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব দুর্বল হয়েছে বলেই আজ তাঁর এই দশা।’’ সকলেরই প্রশ্ন, মোদী কি এ দিন প্রধানমন্ত্রীর মতো বক্তৃতা দিয়েছেন? কেমন সে বক্তৃতা? এ দিন তিনি হাতের ঘড়ি খুলে সাংসদদের দেখিয়ে বলেন, ‘‘ঘড়ি সোজা দেখলে ভারতের সময়, উল্টো ধরলে ব্রিটেনের সময়।’’ পাল্টা বিরোধী বেঞ্চ চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘‘আমরা জানি!’’ শুনে কিছুটা ঢোক গিলে মোদী বলেন, ‘‘অনেকে তো জানেন না।’’
নোট বাতিল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এ দিন চার্বাকের উল্লেখ করে মোদীর মন্তব্য, ‘‘আমি হলে না হয় ঘি খেতে বলতাম। আম আদমি পার্টির সাংসদ ভগবন্ত মান হলে অন্য কোনও পানীয়ের কথা বলতেন!’’ ক’দিন আগে এই ভগবন্ত মান সুরাসক্ত বলে অভিযোগ তুলেছিলেন অনেক সাংসদ। এ দিন মোদীর এ কথা শুনেই রে-রে করে উঠে মান বলেন, ‘‘পঞ্জাবের ভোটেই মানুষ জবাব দেবে। কিছু দিন অপেক্ষা করুন।’’
লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গের বক্তব্যে গত কাল ‘কুকুর’ শব্দটি এসেছিল বলে স্পিকার লোকসভার রেকর্ড থেকে তা বাদ দিয়েছিলেন। আজ মোদী সেই ‘কুকুর’ প্রসঙ্গ তুললেও স্পিকার কিন্তু শব্দটি বাদ দেননি। বিরোধীদের তুমুল প্রতিবাদের মুখেও না। এ নিয়ে কাল সংসদে সরব হবে কংগ্রেস।
আজ বিরোধীরা যে ভাবে বক্তৃতা চলাকালীনই মোদীকে লাগাতার বিঁধে বিদ্রুপ করেছেন, তার নজির সাম্প্রতিক কালে বিশেষ নেই। এ দিন কোমরে হাত দিয়ে মোদী যখন তাঁর সরকারের একের পর এক সাফল্যের কথা বলছেন, তখন তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার বলে ওঠেন, ‘‘আপনার তো অস্কার পাওয়া উচিত! শাহেনশা অমিতাভ বচ্চনের স্টাইলে অভিনয় করছেন!’’ এরই মধ্যে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম বারবার চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘জিও’ ‘জিও’ বলে! জবাবে মোদী বললেন, ‘‘সে তো ওই সংস্থা বলবে।’’ যা শুনে মল্লিকার্জুন পাল্টা বলেন, ‘‘আপনি নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচতে দিন (আপ খুদ জিও, দুসরো কো ভি জিনে দো)।’’
দিনের শেষে বিজেপি শিবিরের বক্তব্য, নোট বাতিল নিয়ে বিরোধীদের এত দিনের আক্রমণের জবাব দিয়েছেন মোদী। আর বিরোধীরা বলছেন, মোটেই না। বরং মোদী আজ কার্যত বলে দিয়েছেন যে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক তিনি করেছেন স্রেফ রাজনীতির জন্য। আর নোট বাতিল নিয়ে ক্যাবিনেটের কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যে তিনি একা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তা-ও সঠিক সময়ে, এই যুক্তি হজম করা কঠিন।
বিজেপির এক প্রবীণ সাংসদের কথায়, ‘‘এক সময় অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁরও বিরোধিতা হতো। কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়ালেই সকলের সম্মান পেতেন। রসিকতা করার অদ্ভুত কৌশল ছিল তাঁর। সম্মান আসলে অর্জন করতে হয়। রসিকতারও একটি মান আছে।’’
আগামিকাল রাজ্যসভায় বক্তৃতা দেবেন মোদী। সেখানে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। বিরোধীরা সেখানে মোদীকে চেপে ধরতে এখন থেকেই প্রস্তুত। কাল মোদী কী করেন, সেটাই দেখার।