এ তুমি কেমন তুমি!
লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় বক্তৃতায় মোদীসুলভ অ্যাড্রিনালিনই অনুপস্থিত। এমনটা মনে করছেন বিজেপির শীর্ষনেতারাই। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরে দেড় ঘন্টার ওই বক্তৃতার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলছে, মোদীই এ বার গরহাজির তাঁর বক্তৃতায়। কোনও প্রকল্প ঘোষণা নেই। এই মোদী মোটেই আক্রমণাত্মক নন। বরং রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট করছেন তিনি। রিপোর্ট কার্ড তুলে ধরছেন আমজনতার সামনে।
১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে স্বাধীনতা অর্জনের পরের সকালে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে জওহরলাল নেহরু ভারতের ভবিষ্যৎ রচনার অঙ্গীকার করেছিলেন। ৭০ বছর পর সেই ভারত এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে দেশের নানা প্রান্তে অশান্তির আগুন, হিংসা, দলিত বিতর্ক। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী কাল জোর দিয়েছেন সামাজিক বিভেদ ভুলে ঐক্য রচনার উপরে। দিল্লির বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জনসংযোগ সংস্থার কর্ণধাররা মনে করছেন, আগের দু’বারের বক্তৃতা থেকে কৌশল অনেকটাই বদলে ফেলেছেন মোদী। এ বারের তিনি অনেক বেশি বাস্তববাদী।
নেহরুর সময়ে টেলিভশন ছিল না। এত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ছিল না। বুলেটপ্রুফ কাচের বাক্সে তাঁকে বক্তৃতা দিতে হয়নি। এ বার লালকেল্লায় বক্তব্য রাখার আগে মোদীকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরতে বলেছিলেন নিরাপত্তা অফিসাররা। আপত্তি জানান তিনি। গোয়েন্দাপ্রধানকে বলেন, ‘‘নিরাপত্তার ব্যবস্থা আপনারা করুন। কিন্তু ওই জ্যাকেট পরে বক্তব্য রাখতে গেলে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে আমার মানসিক সমস্যা হবে।’’ লাল-গোলাপি-সাদা রঙের রাজস্থানি-গুজরাতি স্টাইলে পাগড়ি পরার সিদ্ধান্তও সম্ভবত ভেবেচিন্তেই নেওয়া। অনেকে মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে এক দিকে তিনি গুজরাতি অস্মিতা, অন্য দিকে ভারতের বহুত্ববাদের প্রতি আস্থার বার্তা দিতে চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী এ বারের বক্তৃতায় বোঝাতে চেয়েছেন, শুধু কিছু নীতি নির্ধারণ করেই দায় সারতে রাজি নন তিনি। তাঁর ভূমিকা ‘নিয়ত’। নিরন্তর কাজ করছে তাঁর সরকার। এমনকী, যেটা মোদীসুলভ নয়, আগের সরকারের ভাল কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথাও বলছেন এই মোদী। অবশ্য সেই ভাল কাজগুলিকে যে তিনি আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তা জানাতে ভোলেননি। তবে আর্থিক বিশেষজ্ঞ জগদীশ ভগবতীর মতো কড়া সংস্কারবাদীরা ভেবেছিলেন, ক্ষমতায় এসে মোদী অনেক বেশি আর্থিক সংস্কারমুখী হবেন। দেশের ভর্তুকি সংস্কৃতি দূর করবেন। অনেকে এমনটাও ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা দল এ বার হয়তো আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির ভারতীয় সংস্করণ হয়ে উঠবে। কিন্তু এ বারের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে আর্থিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সরকার যে অনেক বেশি জনমুখী রাজনৈতিক লাইন নিতেই আগ্রহী, সেটাই স্পষ্ট করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী।
জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ দিলীপ চেরিয়ান বলছেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী এসেছিলেন গগনচুম্বী প্রত্যাশা জাগিয়ে। যে কারণে প্রথম ১৫ অগস্টের বক্তব্যে ছিল অনেক স্বপ্নের ফানুস। তার পরের বছরেও রাজনৈতিক মধুচন্দ্রিমা কাটেনি। কিন্তু তৃতীয় বছরে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন বাস্তবের মাটিতে। এ বারের বক্তব্যে উত্তেজনা তাই কম। উচ্চগ্রামে বাঁধা বক্তব্যের বদলে এ হল আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তৃতা। যা অনেকটাই সংযত।’’ আর বিপণন-গুরু পীযূষ পাণ্ডের বন্তব্য, ‘‘এ বার প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি স্পষ্ট। পাকিস্তান নীতি থেকে শুরু করে দলিত বিতর্ক, সামাজিক সাম্য থেকে জনমুখী আর্থিক প্রকল্প, সব কিছুতেই ধোঁয়াশা কম।’’
বিপিএল তালিকায় থাকা মানুষের জন্য স্বাস্থ্য যোজনা থেকে শুরু করে গরিব চাষিদের সমস্যা মেটানো, এ সবই সাবেকি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের চরিত্র। নেহরু থেকে মনমোহন সিংহ, কেউ সে পথ পরিবর্তন করেননি। তিন বছর পর মোদী বুঝিয়ে দিলেন, তিনিও সেই পথ ধরেই এগোতে চাইছেন। তাঁর নিজস্ব মশাল হাতে নিয়ে।