পাঁচ জন প্রতিমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলেও কোনও গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ মন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করলেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দফতরের রদবদল যা-ই হোক না কেন খুব নাটকীয় ভাবে কোনও হেভিওয়েট বিজেপি নেতাকে সংগঠনে অথবা রাজ্যে পাঠিয়ে দিয়ে চাঞ্চল্যকর কাণ্ড ঘটালেন না প্রধানমন্ত্রী। যেমনটা করতেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী।
’৮৪ সালে মৃত্যুর ঠিক দু’মাস আগেও, ৩১ অগস্ট ইন্দিরা নাটকীয় ভাবে লখনউয়ের তখত থেকে বরখাস্ত করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপথ মিশ্রকে। ওই পদে বসিয়েছিলেন নারায়ণ দত্ত তিওয়ারিকে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহকে দিল্লি থেকে এনে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি করে দিয়েছিলেন। যে দিন এই ঘোষণা তিনি করলেন সে দিন দু’জনেই ছিলেন ভিয়েনায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের কোনও সম্মেলনে। তাঁদের কাছে নির্দেশ গেল অবিলম্বে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। ভিয়েনা থেকে দৌড়তে দৌড়তে তাঁরা ফিরলেন। এখানেই শেষ নয়, নারায়াণ দত্ত তিওয়ারির লখনউয়ের মন্ত্রিসভা গঠন করতে সাত দিন সময় লেগে গিয়েছিল। কেননা, দিল্লির কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাংলো থেকে তিওয়ারি তখন ইন্দিরা গাঁধীর বাসভবনে ঘনঘন বৈঠক করতে যাচ্ছেন, মন্ত্রিসভার সদস্য কাদের করবেন আর কাদের করবেন না তাই নিয়ে। দিল্লিতে বসে শুধু প্রথম দু’দিনের মধ্যে বীরবাহাদুর সিংহ আর ব্রহ্ম দত্তকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন তিনি।
সময়টা বদলে গিয়েছে। ধীরে ধীরে রাজীব গাঁধী থেকে নরসিংহ রাও, বাজেপয়ী থেকে নরেন্দ্র মোদী— মন্ত্রিসভা রদবদলের রকমফেরটাই বদলে গিয়েছে। তবে বিজেপি সূত্র আজ মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের পর বলছে, নরেন্দ্র মোদীর কাজ করার ধরনের সঙ্গেও ইন্দিরা ঘরানার বিস্তর তফাৎ আছে। এটা ঠিক, নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসনও ভীষণ ভাবে কেন্দ্রীভূত। অন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। নরেন্দ্র মোদীই প্রথম এবং শেষ কথা। কিন্তু এই কেন্দ্রীভূত শাসনের মহানায়ক হয়েও মোদী কোনও দিনই তাঁর টিমের সদস্যদের ঘনঘন রদবদলের পক্ষে নন। তিনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও কিন্তু টানা ১৫ বছর রাজত্ব করেও রাজ্যমন্ত্রীদের কোর গ্রুপে খুব নাটকীয় রদবদল কখনও করেননি। এ বারও দু’বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদল দেখে তাই কংগ্রেস নেতারা বলছেন বহ্ব্যারম্ভে লঘুক্রিয়া। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের এক কর্তা বললেন, যদি কোনও মন্ত্রক তার কাজে ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয় তা হলে সেটাও প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব সেই গাফিলতি দূর করা। ব্যক্তির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তিনি মন্ত্রিসভায় নাটকীয় পরিবর্তনের পক্ষে নন।
ইন্দিরা গাঁধী মন্ত্রিসভার রদবদলের ক্ষেত্রে সর্বদা রহস্যময়তা বজায় রাখতেন। এক বার অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর সইকিয়াকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে বৈঠক করেন, কিন্তু বৈঠক সেরে গুয়াহাটি ফিরে তিনি জানতে পারেন যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী নেই। অনেক সময় অনেক সচিবদের আচমকা বদল করতেন যা ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও জানতে পারতেন অনেক পরে। রাজীব গাঁধী এক বার সাংবাদিক বৈঠকে সরাসরি বিদেশসচিব বেঙ্কটেশ্বরনকে জানিয়েছিলেন তাঁকে বরখাস্ত করার কথা। ইন্দিরা কারুর সঙ্গে বড় একটা পরামর্শও করতেন না। প্রধান সচিব পি সি আলেকজান্দার, ক্যাবিনেট সচিব কৃষ্ণস্বামী রাও—এদের দু’জনের সঙ্গে অনেক সময় আমলা পর্যায়ের রদবদল নিয়ে কথা বলতেন। মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় বদলের সময় কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে অনেক সময় আগাম জানাতেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী বরং সেই রহস্যময়তার অবসান ঘটাতে চেয়েছেন। মোদীর মিডিয়া উপদেষ্টা না থাকলেও তাঁর গবেষণা টিম-এর মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, রদবদল নয়, মূলত সম্প্রসারণ করতে চাইছেন তিনি। বাড়িতে কিছু সাংবাদিককে ডেকে মন্ত্রিসভা কেন করতে চাইছেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও সুরেশ কলমডি ও সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে শেষ বেলায় করেছিলেন। তাঁর মধ্যেও ইন্দিরার নাটকীয়তার শেষ নিদর্শন ছিল। বিজ্ঞাপন গুরু পীযুষ পান্ডে বলেন, আসলে তখন সে ভাবে মিডিয়া যুগও ছিল না। এখন এত শত চ্যানেল, এত পাপারাৎজি যে সে ভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করাও কঠিন। বরং মন্ত্রীদের নাম আগাম সরকারি ভাবে ফাঁস করে দিলে দলের ভিতর অভ্যন্তরীণ গোলযোগ কমে যায়। বিক্ষুব্ধদের কাছে আচমকা ধাক্কাটা লাগে না। বিজেপি নেতা মীনাক্ষী লেখি বলেন, ‘‘বিজয় গোয়েল মন্ত্রী হচ্ছেন এটা আগে জেনে যাওয়ায় দিল্লির অন্য সাংসদদের উত্তেজনাটা আগাম প্রশমিত হয়ে গিয়েছে। আসলে এমন কোনও সাংসদ আছেন কি, যিনি মন্ত্রী হতে চান না? তা হলে তো প্রধানমন্ত্রীকে ২৮২ জনকে মন্ত্রী করতে হয়!’’