অরুণ জেটলি এবং নরেন্দ্র মোদী।
একটা সময় ছিল যখন বাজেট মানে ছিল এক সাঙ্ঘাতিক গোপন ঘটনা। তখন রাজীব গাঁধী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বেশ মনে পড়ে, বাজেটের দিন বস্তা বস্তা বাজেট পেপার সংসদ ভবনে সন্ধ্যায় যেই বিলি হত, আমলা সাংবাদিক, সর্বোপরি সংসদ সদস্যদের মধ্যে তখনই তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। ওই বাজেট কাগজগুলি তখন কী মূল্যবান। তখন বিভিন্ন শিল্পপতি, গোটা অসম ওই কাগজগুলো পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে থাকত। কত লোককে নিয়োগ করা হত ওই কাগজগুলো আগাম পাওয়ার জন্য। তখন সবে এসেছি। কেন এত পাগলামি তা জানতে চাইতাম প্রবীণ সাংবাদিকদের কাছ থেকে। তখন জেনেছিলাম, বাজেটের তথ্য আগাম জানলে শেয়ারমার্কেটে তার প্রভাব পড়ত। আবার অনেক শিল্পপতি গোষ্ঠী যদি রফতানি শুল্ক বা কর কাঠামো আগাম জেনে যেতেন তবে সে হয়ে যেত এক বড় ব্যাপার।
সে ছিল ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি। পরে সেই প্রথা বদলে গেল। বাজেট ঘোষণা হত লন্ডনের বাজেটের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফলে সন্ধ্যার পর ভারতের বাজেট ঘোষণা হত যখন লন্ডনের স্টক মার্কেট খোলা হত। বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন প্রথম বাজেট পেশের সময় বদলে গেল। এখন তো বাজেটের সেই রহস্যময়তা আর নেই। বাজেট মানে এখন এক স্টেটমেন্ট অফ অ্যাকাউন্ট। আয় ও ব্যয়ের হিসেবনিকেশ মাত্র। আগে আমরা ভাবতাম বাজেট মানেই অর্থনীতির দর্শন। বাজেট দেশের অর্থনীতির চলার পথের দিশা দেখাবে।
আরও পড়ুন: যা ছিল তেরো, হয়ে গেল আঠারো!
অরুণ জেটলি যখন আবার ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর বাজেট পেশ করতে চলেছেন তখন কি বাজেটের কোনও দর্শন আছে? নাকি এ বাজেট একটা আর্থিক বিবৃতি। এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আমাদের জানা নেই। তবে একটা কথা বার বার মনে হচ্ছে, নেহরু ’৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বার বার বলেছেন যে তিনি মতাদর্শগত ভাবে সমাজতন্ত্রী কিন্তু কমিউনিস্ট নন। সমাজতন্ত্র তত্ত্ব ধনী ও গরিবের সংঘাত মিটিয়ে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। নেহরুর মতাদর্শ ছিল অনেক বেশি সোভিয়েত প্রভাবিত। বিশেষত ইউনিয়নের সহায়তায় তিনি নতুন ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠার কথা বললেন।
২০১৪ সালে যখন বিপুল ভোটে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন কিছু অর্থনীতিবিদ ভেবেছিলেন এ বার মোদী দক্ষিণপন্থী সংস্কারের পথে হাঁটবেন। রহস্যময়তা যা ছিল বাজেটের তা হয়তো নেই কিন্তু রাজনৈতিক এক নতুন অভিমুখ মোদী দেবেন। তা হবে ভারতীয় অর্থনীতির এক নতুন অভিমুখ। জগদীশ ভগবতীর মতো অর্থনীতিবিদরা সে সময় যে সব প্রত্যাশার কথা বলেন তাতে অনেকেরই মনে হয়েছিল এ বার হয়তো বিজেপি আমেরিকার রিপাবলিকান দলের এক ভারতীয় শাখায় পরিণত হবে। থ্যাচারের মতো কঠোর আর্থিক সংস্কার হবে এ দেশে। বাস্তবে কিন্তু তা হল না। দেখা গেল, এ বার ভারতীয় অর্থনীতিতে নরেন্দ্র মোদীও হাঁটছেন প্রায় বামপন্থীদের মতোই। সমাজে গরিব মানুষদের কথা ভেবে নানা সামাজিক প্রকল্প। সেই ভর্তুকি। সেই কৃষিঋণ মুকুব। সেই কাজের বদলে খাদ্য। সেই ভাতা। সত্যি কথা বলতে কি রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা ভোটের জন্য খুবই প্রয়োজন। আর আমাদের দেশে ভোট তো প্রতি বছর কোথাও না কোথাও হয়েই চলেছে। এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি এ দেশে।
আরও পড়ুন: বেনজির বিপদ, দেশে কর্মসংস্থান কমছে
এ বারের বাজেটে যেমন প্রবল আর্থিক ঘাটতি, কিন্তু মোদীর পক্ষে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তাকে বিসর্জন দেওয়াও তো সম্ভব নয়। অতএব আপোস। এক দিকে মোদী নামক পপুলিস্ট রাজনৈতিক নেতা গরিব মানুষের জন্য তাঁর রাজনৈতিক তাসটিকে খরচ করতে চান না। আবার অন্য দিকে তিনি চান আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি। সেই বৃদ্ধিও তো এখন ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে। তা হলে? এই আর্থিক ঘাটতিমোচন আর আর্থিক সংস্কারের ভারসাম্য এ বারের বাজেটে সম্ভব কী ভাবে?
আজ গোটা পৃথিবী জুড়েই এই বিতর্ক চলছে যে অর্থনীতিকে সমাজকল্যাণের পথে, গরিব মানুষের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতার পথে নিয়ে যেতে হবে নাকি দক্ষিণপন্থী সংস্কারের পথে নিয়ে যেতে হবে। কোনটা সঠিক পথ? ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতীয় অর্থনীতি পেণ্ডুলামের মতো দুলছে এই দ্বন্দ্বে। যেমন, যোজনা কমিশনে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিতর্ক হয়েছে শিল্প না কৃষি, কী হবে ভারতের অধিকার। ইন্দিরা গাঁধী সংবিধানে সমাজতন্ত্র শব্দটি প্রস্তাবনায় যুক্ত করলেন। তিনি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েও গরিব মানুষের মসিহা হয়ে ওঠেন। আজ নরেন্দ্র মোদীও স্যুট-বুটের সরকার থেকে গরিব কৃষকের সরকার হতে চাইছেন।
আরও পড়ুন: ব্রিফকেস হাতে তিনি এগোচ্ছেন, আহা...
গরিব মানুষের জন্য দাতব্য করতে গেলে জনকল্যাণকামী প্রকল্পে প্রচুর টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ভর্তুকি দিতে হবে। আবার দেশের দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য এ সব বন্ধ করা দরকার, কারণ এই সামাজিক প্রকল্পের বিশাল বরাদ্দ মানেই তো আর্থিক ঘাটতি। আর্থিক ঘাটতি রুখতে দরকার ছিল বিলগ্নিকরণ। কিন্তু কোথায় সেই বিলগ্নিকরণ? শেষ মুহূর্তে মোদী রিটেল ব্যবসার সিঙ্গল ব্র্যান্ডে বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নিলেন মন্ত্রিসভার বৈঠকে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিলগ্নিকরণ, ওএনজিসি থেকে নানা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ— এ সবই তো এখন মোদীর কর্মসূচিতে। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরের তিনি যে এই বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণও করতে পারেননি তাও তো স্পষ্ট। কাজেই না তিনি পেরেছেন ১৯৯১ সালের মনমোহন সিংহ হতে না পেরেছেন ১৯৮৪ সালের প্রণব মুখোপাধ্যায় হতে।
অরুণ জেটলির বাজেট ‘ঘরেও নহে পারেও নহে’-র বাজেট।
১ ফেব্রুয়ারি এই দোদুল্যমানতা থেকে মুক্তির জন্য মোদীকে ভরসা করতে হবে ২০১৮-’১৯ সালে অনেক লগ্নি আসার সম্ভাবনার এক কল্পিত পরিসংখ্যান ধরে ফের আশার ফানুসের উপর। বাজেটের সেই ঔপনিবেশিক গোপনীয়তা দূর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বাজেটের রাজনীতি আজও দূর হল না। বাজেট যে শুধুমাত্র একটা স্টেটমেন্ট অফ অ্যাকাউন্ট, এ ভাবে দেখাই বোধহয় ভাল। কিন্তু তা না করে আমরা আজও বাজেট দর্শন খুঁজি। নির্বাচনী রাজনীতির আঁক কষি, আমজনতাকে খুশি করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি বাজেটে।
‘ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার’-এর একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ে। সেখানে ক্যাবিনেট সচিব অর্থসচিবকে বলছেন, প্রধানমন্ত্রী চকোলেট খেতে চাইতেই পারেন, কিন্তু আপনার কাজ ওঁকে বোঝানো যে সুগারের রোগীর জন্য চকোলেট এত না খাওয়াই ভাল।
ধন্য ভারতীয় সমাজতন্ত্র! ধন্য নরেন্দ্র মোদী!