—ফাইল চিত্র।
গত দু’বছরের মতো এ বারও দীপাবলি সেনা জওয়ানদের সঙ্গেই কাটালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেনাবাহিনীর উদ্দেশে উৎসর্গ করলেন দিনটি। তবে সীমান্তে জওয়ানদের মাঝে যাওয়ার আগে রেডিওয় ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে তিনি আজ কৌশলে উস্কে দিলেন কংগ্রেস জমানায় শিখ নিধনের স্মৃতি।
আগামিকাল, ৩১ অক্টোবর সর্দার বল্লভভাই পটেলের জন্মবার্ষিকী ও ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুবার্ষিকী। সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই ইন্দিরা-হত্যার পরে শিখ-নিধনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন মোদী। পঞ্জাবের ভোটের আগে সে রাজ্যের মানুষের আবেগ উস্কে দিতে বলেন, ‘‘সর্দার পটেল দেশের ঐক্যের জন্য কাজ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাঁর জন্মদিবসেই ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা-হত্যার পরে দেশ জুড়ে সর্দার বা শিখদের হিংসা ও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল।’’ শিখ-নিধনের অস্বস্তিকর প্রসঙ্গে জবাব দিতে না চাইলেও কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, মোদী মুখেই ঐক্যের কথা বলছেন। তাঁর জমানাতেই উল্টে ভেদাভেদ তৈরি করা হচ্ছে।
মোদী, অমিত শাহদের কাছে উত্তরপ্রদেশের ভোট যেমন সম্মানের লড়াই, তেমনই পঞ্জাবের ভোটও বিজেপির কাছে দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ, অকালি দলের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপি সেখানে সরকারে থাকলেও যত দিন এগোচ্ছে, শাসক জোট পিছিয়ে পড়ছে। এগিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি। এই অবস্থায় সেনাদের বীরত্বের জয়গান গেয়ে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে পঞ্জাবেও ফায়দা তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। কারণ কর্মরত বা প্রাক্তন, পঞ্জাবের ঘরে ঘরে সেনাকর্মী। কিন্তু এতেও তেমন লাভ হচ্ছে না মনে করেই মোদী আজ বাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিখ পরিবারগুলিকে তো বটেই, ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন গোটা শিখ সম্প্রদায়কে।
বল্লভভাইয়ের জন্মবার্ষিকী ও ইন্দিরার মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন এই দুই “মহামানব”-কে স্মরণ করে তাঁদের গভীর শ্রদ্ধা জানান মোদী। তখনও শ্রোতারা বুঝতে পারেননি কোন দিকে যাচ্ছেন তিনি। বরং মোদীর মুখে ইন্দিরার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অবাকই করেছিল সকলকে। পর মুহূর্তেই শিখ-নিধনের প্রসঙ্গে চলে যান মোদী। সরাসরি নিজে সেই প্রসঙ্গ তোলেননি। বলেছেন, পঞ্জাব থেকে এক ব্যক্তি ফোনে তাঁকে নিজের যন্ত্রণার কথা শুনিয়েছেন। যা তাঁর মনকে ছুঁয়ে গিয়েছে। ওই ফোন-বার্তাও শোনান মোদী। ওই ব্যক্তি বলেন, সর্দার পটেল নিজের গোটা জীবনে দেশকে একজোট করার কাজ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, সেই দিনেই ইন্দিরা-হত্যা হয় এবং তার পরে দেশে কী ঘটেছিল, তা-ও সকলের জানা। মোদী বলেন, ‘‘এই যন্ত্রণা শুধু এক জনের নয়। সর্দারের জন্মদিনেই ইন্দিরা-হত্যার পর হাজার হাজার সর্দারকে খুন করা হয়। সর্দারের জন্মদিনেই সর্দারদের উপর জুলুমের ইতিহাস আমাদের সকলকেই যন্ত্রণা দেয়।’’
এর আগে কংগ্রেসের সব চেয়ে বড় আইকনকে কৌশলে ব্যবহার করেছেন মোদী। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বচ্ছতা অভিযান শুরু করেছেন তাঁরই জন্ম দিনে। এমনকী, সেই অভিযানের প্রতীক করেছেন গাঁধীজির অতি পরিচিত চশমার রেখাচিত্রকে। যুক্তি, পরিচ্ছন্নতা বড় প্রিয় ছিল মোহনদাসের। এবং মোদীরও! এ বার মোদী শ্রদ্ধা জানালেন কংগ্রেসের আর এক আইকন ইন্দিরার গাঁধীর প্রতি। সঙ্গে জুড়ে নিলেন রাজনীতির নিজস্ব ঘরানা!
গত দু’বছরের মতো এ বারও যে প্রধানমন্ত্রী সেনা জওয়ানদের সঙ্গেই দীপাবলি কাটাবেন, তা জানাই ছিল। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর মোদী সরকার তথা বিজেপি নেতৃত্ব যে ভাবে সেনার জয়গান গেয়ে জাতীয়তাবাদ উস্কে দিতে চাইছেন এবং ওই অভিযানের রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিয়ে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ভোট চাইছে দল, তাতে মোদী যে আজ রেডিওর মন কি বাত-এ সেনার বীরত্বের কথাই বলবেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। সেই মতোই মোদী তাঁর রেডিও-বার্তায় উরির সেনাঘাঁটিতে হামলা, তার পরে ভারতীয় সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর থেকেই সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সেনা জওয়ানরা দেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য নিজেদের সব কিছু বিসর্জন দিচ্ছেন। তাঁদের নিষ্ঠা দেখে আমি অভিভূত। তাই জওয়ানদের জন্য দীপাবলির শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতে বলেছি সকলকে।’’
রেডিও-বার্তায় সেনা জওয়ানদের সম্মান জানানোর পরই ভারত-চিন সীমান্তে, হিমাচলের কিন্নৌরে ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশের সামদো ঘাঁটিতে যান মোদী। জলপাই পোশাকে জওয়ানদের সঙ্গে মিশে যান। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। প্লেট হাতে তাঁদের মিষ্টিমুখ করান। সঙ্গে ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল দলবীর সিংহ সুহাগ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম দীপাবলি মোদী সিয়াচেনে মোতায়েন জওয়ানদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। গত বছর গিয়েছিলেন পঞ্জাবের পাক সীমান্তে। এ বার তিনি উরিতে যেতে চাইলেও নিরাপত্তার কারণে তা বাতিল হয়। সেই কারণেই চিন-সীমান্তের এই জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ ও পঞ্জাবের ভোটের দিকে লক্ষ রেখে মোদী আজ এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। সেনার বীরত্বের কথা বলে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ উস্কে দিয়েছেন। আবার সেনা অভিযানের রাজনৈতিক কৃতিত্ব কৌশলে নিজের মুঠোতেই রেখেছেন। সেনার জন্য তাঁর সরকার যে এক পদ-এক পেনশন ব্যবস্থা চালু করেছেন, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, এই দাবি পূরণ করাটা তাঁর স্বপ্ন ছিল। ‘এক পদ, এক পেনশন’ নীতি ঠিক ভাবে রূপায়ণ হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলে রাহুল গাঁধী কাল প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। আজ মোদী পাল্টা কটাক্ষ করেন, আগের সরকার ‘এক পদ, এক পেনশন’-এর অর্থই বুঝত না।
কাশ্মীর উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে মোদীর আহ্বান, ‘‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই হল আমাদের শক্তি। দেশের সমস্ত নাগরিক ও সব সরকারের দায়িত্ব হল ঐক্য মজবুত করে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে খতম করা। কংগ্রেসের মতে, মোদীর এই ঐক্য বার্তা নিছকই লোক দেখানো। তাঁর জমানাতেই নতুন করে ভেদাভেদ তৈরি হচ্ছে। মোদী যখন শিখ নিধনের প্রসঙ্গে কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছেন, সে সময় কংগ্রেসও ইন্দিরার মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে মোদী-জমানার ভেদাভেদের কথাই তুলে এনেছে সুকৌশলে। ইন্দিরার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কংগ্রেসের বিজ্ঞাপনে তাঁর যে উক্তি তুলে ধরা হয়েছে, তা হল, “দেশের এক জন মানুষেরও বিপদ হলে সেটা আমাদের সকলের জন্যই বিপদ, তা তিনি যে ধর্ম, জাত, ভাষা বা সম্প্রদায়েরই হোন না কেন। সব থেকে ভয়ঙ্কর হল, এর ফলে আমরা সকলে ছোট হয়ে যাই।”