মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর
পূর্ণচ্ছেদের গেরোয় দেশের শিক্ষামন্ত্রী! যেখানে থামার, থামেননি। একটা দাঁড়ি, নিদেন পক্ষে দরকার ছিল সামান্য যতি বা বিরতির। কিন্তু এক নিঃশ্বাসে বলতে গিয়ে ভগৎ সিংহের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু, বল্লবভাই পটেল মায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও ‘ফাঁসিকাঠে’ চড়ালেন প্রকাশ জাভড়েকর!
বলার অপেক্ষা মাত্র। শুরু হয়ে যায় হইচই। একের পর এক তির্যক মন্তব্য আছড়ে পড়তে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে। প্রশ্ন ওঠে, ‘‘ইনিও কি পূর্বসুরির মতো?’’ স্মৃতি ইরানি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী থাকার সময় তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তিনি যখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনই তা তুলনা করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত শিক্ষার মাপকাঠির নিরিখে। স্মৃতিকে সরিয়ে জাভড়েকরকে মন্ত্রী করার পর তাতে ছেদ পড়েছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু সুভাষ–নেহরুকে ‘ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ থিতিয়ে যাওয়া সেই বিতর্কেই ফের জল-হাওয়া জোগালেন নয়া মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীও!
বিজেপির এক নেতা হাসতে হাসতে হালকা চালে বলছেন, ‘‘জাভড়েকর যথেষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি জেনেশুনে এমন ভুল করবেন বলে মনে হয় না। দাড়ি চুলকে বলতে গিয়ে বোধ হয় দাঁড়ি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।’’ কিন্তু সুযোগ পেয়েই ফের গেল গেল রব তুলেছেন কংগ্রেস নেতারা। তাঁরা বিঁধেছেন, ‘‘ব্যাটনটা দেখছি ঠিক লোকের হাতেই গিয়েছে। কেউই কম যান না।’’
বিতর্কের সূত্রপাত মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়াড়ায়। স্বাধীনতার ৭০ বছর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিরঙ্গা যাত্রা করছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। ছিন্দওয়াড়ায় তেমনই এক অনুষ্ঠানে জাভড়েকর বলেন, ‘‘১৮৫৭ মে যো লড়াই শুরু হুয়ি, নব্বই সাল লড়াই চলি, অর ব্রিটিশ কো বাহার কর দিয়া, অর দেশ আজাদ হো গ্যয়া, উন সভি সেনানিও কো হম নমন, হম সালাম, হম প্রণাম করতে হ্যয়। কিতনে বীর— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, সর্দার পটেল, পণ্ডিত নেহরু, ভগৎ সিং, রাজগুরু, সভি যো ফাঁসি পে চঢ়ে, ক্রান্তিবীর সাভারকরজি, বাকি সব মহান স্বতন্ত্রতা সেনানি.... ’’
কত বীরের উদাহরণ দিতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র, পটেল, নেহরুর নাম করার পরে দরকার ছিল একটু বিরতির। তা না দিয়েই ভগৎ সিংহ, রাজবীরদের মতো শহিদদের প্রসঙ্গে বলতে থাকাতেই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। কেউ মন্তব্য করেন, ইনি তো দেখছি স্মৃতি ইরানির চেয়ে কম যান না! কেউ লেখেন, আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম বড় রহস্য হল সুভাষ বসুর অন্তর্ধান। মনে হচ্ছে জাভড়েকর জেমস বন্ড সেই রহস্যভেদ করে ফেলেছেন। আর কংগ্রেসের মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারির টিপ্পনি, ‘‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কার হাত থেকে কার হাতে এসে পড়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে!’’
পরিস্থিতি সামলাতে পরে মুখ খোলেন জাভড়েকর। পরপর চারটে টুইট করে বলেন, ‘‘খবরটা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি আমার বক্তব্যে ১৮৫৭ থেকে সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে সম্মান জানিয়েছি। আমি গাঁধী, নেহরু, সুভাষ বসুর উল্লেখ করেছিলাম। তার পরে একটা ফুলস্টপ ছিল। পরের বাক্যে আমি তাঁদের কথা বলেছিলাম যাঁরা কারাগারে বন্দি ছিলেন, ইংরেজদের হাতে অত্যাচারিত হয়েছিলেন বা যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। যাঁরা শ্রোতা ছিলেন, মনে হয় না তাঁদের বুঝতে কোনও ভুল হয়েছে।’’
বিতর্ক থামাতে জাভড়েকর ব্যাখ্যা দিলেও সাম্প্রতিক কালে বার বারই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে। গত ১৮ অগস্ট সুভাষচন্দ্র বিমান দুর্ঘটনার দিনটিকে তাঁর মৃত্যুদিন হিসেবে উল্লেখ করে টুইট করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় সেই টুইট মুছে দেওয়া হয়। বিতর্ক এ বার সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে জাভড়েকরের মন্তব্যে। যার প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক তাস খেলছেন ওঁরা। মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব। প্রথমে জেটলি, এখন জাভড়েকর। অনেক দিন তো এসেছেন ক্ষমতায়। এ সব তথ্য এত দিন প্রকাশ্যে আনেননি কেন? কোনও রহস্য আছে!’’
গত লোকসভা ভোটের প্রচারে নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন গুপ্ত বংশের। আর বিহারে প্রচারে গিয়ে তিনি দাবি করে বসেন, আলেকজান্ডার গোটা পৃথিবী জয় করলেও, বিহারবাসীর কাছে তাঁকে পরাস্ত হতে হয়েছিল। কম যাননি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। অসমে প্রচারে গিয়ে তাঁর দাবি ছিল, অহম রাজারা মোঘলদের ১৭ বার পরাস্ত করেছিলেন। যদিও ইতিহাস তা বলে না। বিজেপি নেতাদের ভুলের এই ধারাবাহিকতা দেখে কংগ্রেসের এক নেতার কটাক্ষ, ‘‘এটাই সম্ভবত ওঁদের ট্র্যাডিশন। সর্বক্ষণ ইতিহাস পাল্টানোর চিন্তা মাথায় থাকায় বিজেপি নেতারা প্রায়ই ইতিহাসটা গুলিয়ে ফেলেন।’’