পুড়ে খাক একের পর এক বাড়ি। পুলিশ ও জবরদখলকারীদের সংঘর্ষে জ্বলছে মথুরার জওহরবাগ। ছবি: পিটিআই।
রণক্ষেত্র মথুরা। জ্বলছে কৃষ্ণ জন্মভূমি। জমি জবরদখলের যুদ্ধে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশের সঙ্গে জবরদখলকারীদের সাড়ে তিন ঘণ্টার খণ্ডযুদ্ধে মোট ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন পুলিশ— শহরের পুলিশ সুপার মুকুল দ্বিবেদী এবং স্টেশন অফিসার সন্তোষ যাদব।
মথুরা সেনা ছাউনি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে জওহরবাগ। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এই বাগানে দু’দিনের জন্য ধর্নায় বসার অনুমতি চেয়েছিল একটি সংগঠন। তার আবার একাধিক নাম। পুলিশ জানাচ্ছে, ওই সংগঠনের সদস্যেরা নিজেদের স্বাধীন ভারত সুভাষ সেনা বা ভারতীয় সুভাষ সেনা, স্বাধীন ভারত-এর কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। সে বছর জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশের সাগর এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, গুজরাত ঘুরে মার্চে তারা এসে পৌঁছয় মথুরা। পুলিশকে তারা জানিয়েছিল, দু’দিনের ধর্না শেষে দিল্লি চলে যাবে।
আবেদন মঞ্জুর করে প্রশাসন। ধর্না শুরু হয়। কিন্তু কথামতো দু’দিন পরে তা উঠে যায়নি। দু’বছর পরেও না। উল্টে ২৭০ একরের পার্কে অস্থায়ী কাঠামো গড়ে জাঁকিয়ে বসে সংগঠনের আড়াই থেকে তিন হাজার অনুগামী। যারা নিজেদের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকৃত ভক্ত বলে দাবি করে। এক সময় তাদের নেতা ছিলেন জয় গুরুদেব ওরফে তুলসীদাস নামে এক ধর্মীয় গুরু। তিনিই নেতাজি বলে দাবি করতেন তাঁর ভক্তরা। যদিও ২০১২ সালে তুলসীদাসের মৃত্যুর পরে নেতাজিকে দেশে ফেরানোর দাবিতে সরব হয় তারা। এদের বাকি দাবিদাওয়াও অদ্ভুতুড়ে। যেমন, ভারতের টাকা বাতিল করে আজাদ হিন্দ ফৌজের টাকা চালু করতে
হবে। তাতে নাকি এক টাকায় ৯৭২ গ্রাম সোনা বা ৬০ লিটার ডিজেল কেনা সম্ভব!
দাবি যতই উদ্ভট হোক, ভোট রাজনীতির টানে এই সংগঠনটির পিছনে অখিলেশ যাদব সরকারের মদত ছিল বলেই বিরোধীদের অভিযোগ। প্রশাসনের একাংশেরও এমনই বক্তব্য। বিজেপির দাবি, জবরদখলকারীদের ওই জমিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সমাজবাদী পার্টিই। তাদের রেশন কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এমনকী পার্কের মধ্যে খোলা হয়েছে রেশন দোকান। দলের জাতীয় সচিব শ্রীকান্ত শর্মার কথায়, ‘‘জমি হাতানোর জন্য সমাজবাদী পার্টির জমি মাফিয়ারা পরিকল্পনামাফিক এই কাজ করছিল।’’ অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন বিএসপি নেত্রী মায়াবতী। সমাজবাদী পার্টি সূত্রেও বলা হচ্ছে, জওহরবাগের বেশির ভাগ দখলদারই যাদব। যারা দলের মূল ভোটব্যাঙ্ক। সেই কারণেই তাদের চটানো হয়নি। যখনই তাদের তুলে দেওয়ার কথা উঠেছে, তখনই চাপের মুখে পিছিয়ে আসতে হয়েছে প্রশাসনকে।
শেষ পর্যন্ত কিছু দিন আগে একটি জনস্বার্থ মামলার রায়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ওই জমি খালি করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে সেই কাজ করতে গিয়েই ধুন্ধুমার। মথুরা (সিটি) পুলিশ সুপার মুকুল দ্বিবেদী নিজে নেতৃত্ব দেন অভিযানের। পুলিশ জানিয়েছে, একেবারে প্রথম সারিতে ছিলেন মুকুল ও ফারহা থানার স্টেশন অফিসার সন্তোষ কুমার। বিক্ষোভকারীরা লাঠি, কুডু়ল, তরোয়াল নিয়ে পুলিশকে বাধা দেয়। পুলিশের দাবি, বিক্ষোভকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু আচমকা গাছের উপর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে এক দল দুষ্কৃতী। ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন মুকুল দ্বিবেদী ও সন্তোষ কুমার।
দুই অফিসার ঘায়েল হওয়ায় পুলিশ প্রাথমিক ভাবে পিছিয়ে যায়। ডাকা হয় র্যাফ ও বিশাল পুলিশ বাহিনী। গুলি চালায় জওয়ানরাও। পাল্টা প্রতিরোধে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা কোণঠাসা হতেই পার্কের এক কোণ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। অফিসারদের অনুমান, পার্কে রান্না করার জন্য যে শ’খানেক সিলিন্ডার রাখা ছিল, তাতে পরিকল্পিত ভাবে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে পার্কের ওই অংশটি। বিস্ফোরণে প্রায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে ২২ জন বিক্ষোভকারী মারা গিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। এদের মধ্যে ৫ জন মহিলা এবং ২ জন শিশু। গুরুতর জখম আরও ৭৫-১০০ জন। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি
২৩ জন পুলিশও।
আজ পার্কে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। যার মধ্যে রয়েছে ৪৫টি পিস্তল, ৫টি রাইফেল, ১৭৮টি হ্যান্ড গ্রেনেড এবং প্রচুর কার্তুজ। এত অস্ত্র মজুত থাকার খবর যে পুলিশের কাছে ছিল না, তা মেনে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ। তাঁর কথায়, ‘‘এটা পুরোপুরি প্রশাসনিক ব্যর্থতা। বিক্ষোভকারীদের কাছে যে এত অস্ত্র ছিল, সেটা পুলিশের জানাই ছিল না।’’ উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এডিজি দলজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘রামবিকাশ যাদব, চন্দন বসু, গিরিশ যাদব ও রাকেশ গুপ্ত হল মূল অপরাধী। তারাই পুলিশের উপরে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল। এদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’ ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে ৩২০ জন।