পরিষদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর নীতীশ কুমার। শনিবার। ছবি:পিটিআই
মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসিয়েছিলেন নীতীশ কুমার। রাজনীতির ঐতিহ্য মেনে তাঁকেই কোণঠাসা করে নিজের রাজনৈতিক পরিচয় তৈরির চেষ্টা করেছিলেন জিতনরাম মাঁজি। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরতে হল তাঁকে। ফের সেই গদিতে বসতে উদ্যোগী হয়েছেন নীতীশ। রাজনীতির আবর্তে বিহারের মসনদ নিয়ে বল চলে গিয়েছে রাজ্যপালের কোর্টে।
লোকসভা নির্বাচনে জেডিইউয়ের ভরাডুবির পরে নীতীশ কুমার মে মাসে দলিত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জিতনরামকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসান। কিন্তু ক্রমশ নানা বিতর্কিত মন্তব্য করতে শুরু করেন জিতনরাম। তাতে অস্বস্তিতে পড়ছিল দল ও বিহার সরকার। রাজনৈতিক সূত্রে খবর, জিতনরাম যে নিজের রাজনৈতিক পরিচয় তৈরির খেলা শুরু করেছেন তা বুঝতে পারছিলেন নীতীশ। বিহারে নীতীশের একদা জোটসঙ্গী বিজেপিও যে জিতনরামকে মদত দিচ্ছে তাও জানতেন তিনি। দলের মধ্যেও জিতনরামকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর দাবি ওঠে। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং মুখপাত্র কে সি ত্যাগী জিতনরামকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিবৃতিও দেন। নীতীশ অবশ্য তখন এ নিয়ে তখন মুখ খোলেননি।
তবে জিতনরামকে যে সরানো হতে পারে, তা নিয়ে দলের মধ্যে জল্পনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। গত কালই জিতনরামের সমর্থক মহাদলিত সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ পটনায় জেডিইউয়ের দফতরে বিক্ষোভ দেখান। জিতনরামকেই মুখ্যমন্ত্রী রাখতে হবে বলে স্লোগান দেন তাঁরা। নীতীশের সমর্থকরা প্রতিবাদ করলে হাতাহাতিও হয়।
নীতীশ কুমার-ঘনিষ্ঠ দুই মন্ত্রী রাজীবরঞ্জন সিংহ লাল্লন ও পি কে শাহিকে গত কাল রাতে সরিয়ে দেন জিতনরাম। এর পরেই সক্রিয় হন নীতীশ। জিতনরামের শিবিরে থাকা প্রভাবশালী মন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহকে নিজের দিকে টেনে নেন তিনি। আজ নীতীশের সঙ্গে বৈঠকও করেন জিতনরাম। দলীয় সূত্রে খবর, নরেন্দ্র সিংহই দুই শিবিরের মধ্যে সমঝোতা করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু লাল্লন ও শাহিকে সরানোর সিদ্ধান্ত বদলাতে রাজি হননি জিতনরাম। ফলে আলোচনা ভেস্তে যায়।
আজ জেডিইউ দলের সর্বভারতীয় সভাপতি শরদ যাদব পরিষদীয় দলের বৈঠক ডেকেছিলেন। কিন্তু জিতনরাম রাজ্যপালকে চিঠি লিখে জানান, এই বৈঠক অবৈধ। কারণ, পরিষদীয় দলের নেতা মুখ্যমন্ত্রী। এই বৈঠক ডাকার অধিকার কেবল মুখ্যমন্ত্রীরই আছে। বিহারের অতিরিক্ত দায়িত্ব এখন রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর হাতে।
দলীয় সূত্রে খবর, এ বার বেজায় চটেন নীতীশ। জিতনরামকে ডেকে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি শরদ যাদবের উপস্থিতিতে নীতীশ তাঁকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।
জিতনরাম দলের এই নির্দেশ পাওয়ার পরে নেতৃত্বের কাছে এক ঘণ্টা সময় চান। আগেই রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা ছিল। রাজনীতিকদের মতে, জিতনরাম পাল্টা চাল দিতেই সময় নিয়েছিলেন। দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেন। কিন্তু ৩১ জন মন্ত্রীর মধ্যে ২১ জনই সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। হাওয়া যে নীতীশের পক্ষে বইতে শুরু করেছে তা তখনই বুঝতে পারেন রাজনীতিকরা। তবে নিয়ম অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর পেশ হওয়া ওই সুপারিশ রাজ্যপালের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে নীতীশের পাশে থাকতে ২০ জন মন্ত্রী ইস্তফাও দেন।
পরিষদীয় দলের বৈঠকে নীতীশ কুমারকে ফের নেতা নির্বাচিত করা হয়। পরিষদীয় মন্ত্রী শ্রবণ কুমার বলেন, “পরিষদীয় দলের বৈঠকে নীতীশ কুমারকে নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে। জিতনরাম মাঁজিকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
নেতা নির্বাচিত হওয়ার পরে নীতীশ কুমার বলেন, ‘‘জিতনরামের ভূমিকায় মানুষ বিশ্বাস হারাচ্ছিলেন। মানুষের সমস্যা বাড়ছিল। সকলে মিলে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলাম। সকলের এই সহযোগিতার মর্যাদা তিনি রাখতে পারেননি।”
জিতনরামের পিছনে বিজেপি আছে বলে আজ অভিযোগ করেছেন নীতীশ ও শরদ যাদব। বিজেপির পাল্টা দাবি, মহাদলিত সম্প্রদায়ের এক জনকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন নীতীশ। কিন্তু ক্ষমতার লোভে ফের তিনি গদিতে ফেরার চেষ্টা করছেন।
বিহার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ দিল্লি যান বিহারের বিজেপি নেতা সুশীল মোদী। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকে দিল্লির সঙ্গে বিহার নিয়েও আলোচনা হয়। প্রকাশ্যে বিহারে এখনই ভোটের পক্ষে সওয়াল করেছেন সুশীল মোদীর মতো নেতারা। দলীয় সূত্রে খবর, বিহারে সদস্য বাড়ানোর অভিযান এখনও শুরু করা যায়নি। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিহারে ভোট হওয়ার কথা। ভোট এগিয়ে এলে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বিজেপি প্রস্তুত আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে বলে মনে করছেন নরেন্দ্র মোদী, সুষমা স্বরাজ, অমিত শাহ, অরুণ জেটলিরা। আপাতত স্থির হয়েছে, মহাদলিত সম্প্রদায়ের এক নেতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে নীতীশের বিরুদ্ধে প্রচার হবে। সেই সঙ্গে নিজেদের শক্তি খতিয়ে দেখা হবে।
দিল্লির রাজনীতিকদের মতে, নীতীশ যে এখনই কড়া পদক্ষেপ করলেন তার অন্য কারণও রয়েছে। জিতনরামকে বিজেপি মদত দিচ্ছে। এখন দিল্লিতে বিজেপি জিতলে জিতনরামের হাতশক্ত হতে পারত। আবার দিল্লিতে বিজেপি হারলে বিহারেও বিজেপি-বিরোধিতার হাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন নীতীশ। তাই ঠিক দিল্লি ভোটের দিন জিতনরামকে সরিয়ে মোক্ষম চাল দিয়েছেন তিনি। অবশ্য এখনও মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়ার লক্ষণ দেখাননি জিতনরাম। বরং নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি এসেছেন তিনি। জিতনরামের ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর, তিনি মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সময় চেয়েছেন। বিজেপির তরফে অবশ্য এখনও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।
নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসলে সংখ্যার হিসেব তাঁর পক্ষেই রয়েছে বলে জানাচ্ছেন রাজনীতিকেরা। জেডিইউয়ের পরিষদীয় দলের বৈঠকে ১১৫ জনের মধ্যে ৯৭ জন নীতীশকে সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়াও লালুপ্রসাদের দল আরজেডির ২৪ জন বিধায়কেরও সমর্থন আছে। সিপিআইয়ের ১ জন, কংগ্রেসের ৫ জন ও ৫ জন নির্দল বিধায়ক রয়েছেন। এর মধ্যে সিপিআই ও কংগ্রেসও রয়েছে নীতীশের পাশে। বিজেপির আছে ৮৮ জন বিধায়ক। ২৪৩ জন সদস্যের বিহার বিধানসভায় এখন ২৩৩ জন বিধায়ক রয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ১২০ জনের সমর্থন প্রয়োজন। ফলে রাজ্যপাল বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা করতে চাইলে নীতীশ সহজেই উতরে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজ্যপাল জানিয়েছেন, তিনি বিহার থেকে চিঠি পেয়েছেন। ব্যবস্থাও নিয়েছেন। নীতীশ-ঘনিষ্ঠ দুই মন্ত্রীকে সরানো ও বিধানসভা ভাঙা-দুই নিয়েই সুপারিশ তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন জিতনরাম। রাজ্যপাল কোন চিঠির কথা বলেছেন তা স্পষ্ট নয়।
বিহারের জল কোন দিকে গড়ায় তা দেখতে উদগ্রীব সব শিবিরই।
(সহ প্রতিবেদন: দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খদীপ দাস)